যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল কেন বেছে নিল না তুরস্ককে?
অনলাইন নিউজ ডেক্স
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিক অস্ত্রবিরতির মধ্যস্থতা করার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতার।
এ ঘটনার পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতার সূক্ষ্মভাবে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষায় নিজের ভূমিকা তুলে ধরেছে।
দেশটি একদিকে যেমন পশ্চিমাদের কাছে ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ হিসেবে পরিচিত সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছে, তেমনি আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষাবিষয়ক সম্পর্কও বাড়িয়ে যাচ্ছে।
গত ২৪ নভেম্বর থেকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চার দিনের একটি অস্ত্রবিরতি শুরু হয়। পরে সেটি আরও দুদিন বাড়ানো হয়। এই অস্ত্রবিরতির মধ্যস্থতা করেছে কাতার।
আরও পড়ুন: ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ
কাতারের পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি একটি চুক্তির ঘোষণা করেন, যার মধ্যে অস্ত্রবিরতি এবং ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চলতি সংঘাতের শুরু থেকেই মিশর আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছিল কাতার।
কাতারের যত মধ্যস্থতা
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ নিজেদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— মিশর, ওমান ও কুয়েত। তবে এদের ছাপিয়ে ওই অঞ্চলে কাতারই সংকট সমাধান ও আলোচনার উদ্যোক্তা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ইউক্রেন থেকে শুরু করে লেবানন, সুদান, ইরান, আফগানিস্তান এবং গাজা সংকটে মধ্যস্থতা করেছে কাতার।
২০১৭ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইরাকে আটক জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় সাহায্য করেছিল কাতার। অবশ্য ওই জিম্মিদের মধ্যে কাতারের ক্ষমতাসীন পরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
২০১৯ সালে আফগানিস্তানের তালেবানদের হাতে আটক দুজন পশ্চিমা জিম্মির মুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিল কাতার। ২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও ভূমিকা রাখে দেশটি। আর চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে বন্দিবিনিময়েও কাজ করে দোহা।
কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ ঘাঁটি আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের সময় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। একই সঙ্গে কাতার তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সমঝোতা আলোচনায় স্বাগতিক দেশ হিসেবেও কাজ করেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ছোট দেশ হলেও তরল গ্যাস সমৃদ্ধ ধনী এই দেশটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে, একই সঙ্গে প্রতিবেশী দুই বড় দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে। যার কারণে সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে চেয়েছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক আতেফ আল-শায়ের বলেন, কাতার এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু ঘটনায় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সফলভাবে মধ্যস্থতা করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দিবিনিময়ে কাতার ভূমিকা পালন করেছে।
আমেরিকান ও তালেবানদের মধ্যে মধ্যস্থতায়ও কাতার সফল হয়েছে। ফলে মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে কাতার এলেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, মানবিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংকট সমাধানে কাতার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ সংঘাতে যুক্ত থাকা দুপক্ষের ব্যক্তিরাই কাতারে রয়েছে। আর কাতার নিজেও এই ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো যেসব ‘রাষ্ট্র নয় এমন সত্ত্বা’ যেমন বিভিন্ন আদিবাসী ও সশস্ত্র-বাহিনী- যাদের সাথে আলোচনায় প্রস্তুত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীগুলোর সাথেও আলোচনা করে কাতার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী, হামাস এবং ফিলিস্তিনের অন্যান্য সংগঠন যেমন ইসলামিক জিহাদ।
বার্তা সংস্থাগুলো অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্য অনুযায়ী, কাতারে আশ্রয় নিয়েছেন হামাসের শীর্ষ নেতা খালেদ মাশাল যিনি ১৯৯৭ সালে জর্ডানে ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। এ ছাড়া হামাসের সুপ্রিম লিডার ইসমাইল হানিয়া কাতারে বাস করেন।
ইরানের সঙ্গেও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক বিলিয়ন ডলারের যৌথ প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে তাদের।
গত কয়েক দশকে এ ধরনের সম্পর্ক কাতারকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে দেশটি এই গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরাইলের চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করে থাকে। দুই পক্ষের হয়েই চুক্তির বিষয়ে দরকষাকষি করে এই দেশটি।
এ অবস্থাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘সবার বন্ধু, কারও বন্ধু নয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তুরস্ক নয় কেন?
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে অস্ত্রবিরতির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু তাদের বেছে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
তুরস্ককে বেছে না নেওয়ার কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক আতেফ আল-শায়ের জানিয়েছেন বলেন, তুরস্কের তুলনায় কাতার যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের একটা ঘাঁটিও রয়েছে। হামাসেরও ঘাঁটি রয়েছে কাতারে।
তিনি মনে করেন, ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যে এখন সুসম্পর্ক যাচ্ছে না। কারণ তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনের বিষয়ে সব সময়ই সমালোচনা করে আসছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল দুই দেশই এমন একটি দেশকে চাইছিল যারা আসলেই সমঝোতায় ভূমিকা রাখতে পারবে।
আল-শায়ের বলেন, তারা কাতারকে বেছে নিয়েছে। কারণ মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে কাতারের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ঐতিহ্যগতভাবেই কাতার এ ধরনের সংঘাতের সমাধান করে আসছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।