যুগপৎ আন্দোলনে দলের পরিধি বাড়ছে


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তাপ দিন দিন আরও বাড়ছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান এখনও দুই মেরুতে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের পদত্যাগসহ নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে আন্দোলন জোরদার করছে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৩৬ দল। একই সঙ্গে এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের পরিধিও বাড়ছে। চারটি দল যুক্ত হচ্ছে, অপেক্ষায় আছে আরও ছয়টি। দাবি আদায়ে সিপিবি-বাসদসহ ছয় দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটও যেসব কর্মসূচি পালন করছে, সেগুলোরও সদৃশ রয়েছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে। তবে দাবি ও কর্মসূচিতে মিল থাকলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকার কথা জানিয়েছেন বাম জোটের নেতারা। এর বাইরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে পৃথকভাবে মাঠে রয়েছে। বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দাবি থাকলেও বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন-এ দুই দাবির সঙ্গে সব দলের মিল রয়েছে। দাবি আদায়ে ভিন্ন প্ল্যাটফরম থেকে কর্মসূচি পালন করলেও মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলন জোরালো করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ সময় ঐক্যবদ্ধভাবেও কর্মসূচিতে যেতে পারে সব দল। যা চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ নেবে বলে আশা করছেন নেতারা। এজন্য যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা বিভিন্ন দল ও জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। কিছুটা ছাড় দিতেও রাজি দলটি। সংশিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার বলেন, ‘সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। একদফা দাবিতে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছি। এর বাইরে একই দাবিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছে। সবার দাবি একই, সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তাহলেই একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। নইলে সামনে চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে ৩৬টি রাজনৈতিক দল আছে, পরিধি আরও বাড়ছে। সামনে আন্দোলনের মাঠে আরও বাড়বে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামনে আন্দোলনের ঢেউ তৈরি হবে, গণঅভ্যুত্থান হবে। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৩৬ রাজনৈতিক দলের মধ্যে রয়েছে-গণতন্ত্র মঞ্চে থাকা ৫ দল, ১২ দলীয় জোটের ১১ দল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটে ৯ দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যে ৪টি দল। এককভাবে যুগপৎ-এ রয়েছে ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ নেতৃত্বাধীন এলডিপি, মোস্তফা মহসিন মন্টু নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, বাবুল সরদার চাখারী নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ ও নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, ববি হাজ্জাজের এনডিএম ও ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি। এর বাইরে আন্দালিব রহমান পার্থ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে এবি পার্টি, কেএম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি ও তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে জনতার অধিকার পার্টি যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা একদফা দাবিতে কয়েকটি কর্মসূচি পালনও করেছে। এছাড়া দুটি বাম ঘরানারসহ আরও ছয়টি দলও যুক্ত হওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে বলে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না এটা আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা একই লক্ষে আন্দোলন করছি। সামনে যদি পরিস্থিতি বাধ্য করে তাহলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের পরিবেশও হতে পারে। বিএনপি নেতারা বলেন, বিরোধী সব দলের দাবি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন কারও কাছে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমনকি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারেনি। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও সংস্থাসহ সবারই এখন প্রত্যাশা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তা হতে হলে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এদিকে রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশে এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। যদিও বিএনপি ও জামায়াত-দুটি দলেরই আন্দোলনের লক্ষ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো। দাবি-কর্মসূচিতে মিল সিপিবি-বাসদ জোটের : সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বাম গণতান্ত্রিক জোটেরও। দাবি আদায়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি বড় সমাবেশ রয়েছে। সিপিবি-বাসদ এই জোটের প্রধান দাবির মধ্যে আরও রয়েছে-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, রেশনিং ব্যবস্থা ও ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ, পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘বর্তমানে একটি ফ্যাসিবাদি সরকার চেপে বসেছে। তারা মানুষের ভোটাধিকার পর্যন্ত খর্ব করেছে। লুটপাটতন্ত্র এমন জায়গায় গেছে যে তারাই এই ক্ষমতাটা দখল করে আছে। এই সুযোগে বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তিও বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন। বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের বদলে বিএনপি বা অন্যদের বসানো তাদের লক্ষ্য নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, ঐক্য ন্যাপ ও বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ফলে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।’ বাংলাদেশ জাসদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ছিল। কিন্তু তারা এখন সেই জোটে নেই। কয়েক বছর ধরে দলটি নিজস্ব কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন দলটি বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে। বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন, দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। তবে গণতন্ত্র বিশ্বাস করলে সমঝোতা করে নির্বাচন করাটা দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। সেজন্য আলাপ-আলোচনা করে একটি পথ বের করা উচিত। সরকার একগুয়েমি বা কর্তৃত্ব-পরায়ণ যে রাজনীতি এতদিন ধরে করছে, তার ফলে মানুষের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে তাই। পদত্যাগসহ দাবি মানা না হলে সামনে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন বনাম জনগণ হয়ে যাবে।’