যুদ্ধের আগে যে নিষেধাজ্ঞা ইরাককে পঙ্গু করে দিয়েছিল


হাজার হাজার সেনা পাঠিয়ে ইরাক ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত দখল করে নেওয়ার পর বাগদাদের ওপর নেমে এসেছিল ব্যাপক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। দীর্ঘসময় ধরে এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছিল মূলত দেশটির শাসক সাদ্দাম হোসেনকে চাপে ফেলার জন্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই নিষেধাজ্ঞা ইরাক সরকারকে যতটা না কাবু করেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি ভুগতে হয়েছে সাধারণ জনগণকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বিবিসিকে বলেন, গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির ধোয়া তুলে যে অভিযান যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছিল, তার আসলে কোন ভিত্তি ছিল না, যা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তার মতে, সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের যে উদ্দেশ্য ছিল তা পূরণ হয়নি, বরং সাধারণ মানুষ এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। পরে অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। কী নিষেধাজ্ঞা ছিল? জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যা চলেছে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হওয়ার কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এর স্থায়ী সদস্যদের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা কিছুটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগেই ১৯৯০ সালের ৬ই আগস্ট ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইরাকের সঙ্গে সব ধরনের আমদানি ও রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তবে শুধু ওষুধের ওপর এই নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সম্ভব হতো না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলে, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে আমদানি-রপ্তানি অব্যাহত রাখতো। জাতিসংঘের কূটনীতিক মাত্তি আহতিসারি ইরাকের তৎকালীন পরিস্থিতিকে ‘প্রায় মহাবিপর্যয়ের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, ইরাক আসলে ‘শিল্পযুগ-পূর্ববর্তী’ সময়ে ফিরে গেছে। মিডল-ইস্ট রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রজেক্ট-মেরিপ নামে একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থায় ২০২০ সালে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল জাস্টিস কর্মসূচির অধ্যাপক জয় গর্ডন। ইরাকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তিনি “ইনভিজিবল ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এন্ড দ্য ইরাক স্যাংশন্স” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহতা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। এই দুটি দেশ মিলে ১৯৯৬ সালে যে \'নো-ফ্লাই জোন\' ঘোষণা করেছিল তার আওতায় ছিল ইরাকের প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড। ১৯৯৮ সালে অপারেশন ডেজার্ট ফক্স পরিচালনা করেছিলে এই দুটি দেশ, যাতে ইরাকের শতাধিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়, ব্যবহার করা হয় এক হাজারেরও বেশি বোমা এবং ক্রুজ মিসাইল। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর একই বছরের মে মাসে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তবে তখনও অস্ত্র এবং তেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এক ভোটের মাধ্যমে তেল বিক্রির মুনাফা ইরাকের সরকারি তহবিলে দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। অধ্যাপক জয় গর্ডন তার লেখায় বলেন, ১৯৯০ এর দশকে ইরাকে মানবিক সহায়তা পণ্য প্রবেশ করতে না দেয়ায় মূল ভূমিকা রেখেছে দুটি দেশ-যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন। কোটি কোটি ডলার মূল্যের জরুরি পণ্য যেমন খাদ্য উৎপাদন, পানি পরিশোধন, রাস্তা সংস্কার, বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং টেলিযোগাযোগর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের প্রবেশ ইরাকে স্থগিত রাখা হয়েছে টানা কয়েক মাস, এমনকি বছর ধরে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল- এসব পণ্যের ‘দ্বৈত ব্যবহার’ রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য বেসামরিক এবং সামরিক-দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়। যেমন বিদ্যুৎ, রাস্তা, টেলিফোন, নির্মাণ সরঞ্জাম, যানবাহন ইত্যাদি। এ কারণে ইরাকের সাধারণ জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা না করেই এসব পণ্য সরবরাহ স্থগিত করা হতো। উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপক জয় গর্ডন বলেন, ওষুধ প্রবেশে অনুমোদন ছিল। কিন্তু ওষুধকে ঠান্ডা ও কার্যক্ষম রাখতে যে রেফ্রিজারেটর ও ট্রাক দরকার তা দেয়া হতো না। পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট খুলে দেওয়া হয়েছিল ব্যাপক হারে কলেরা ও টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়ার পর। কিন্তু এটিকে সচল রাখতে যে জেনারেটর দরকার তা দেয়া হয়নি। কারণ এটির ‘দ্বৈত ব্যবহার’ ছিল। একই কারণে প্রায় সব ধরনের কম্পিউটার সরঞ্জামাদিও দেয়া হতো না, যদিও হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এগুলো জরুরি ছিল। সেচ এবং পানির লবণাক্ততা দূরীকরণের যন্ত্রপাতি দিতে দেরী করা হতো যার কারণে ভুগেছে ইরাকের কৃষিখাত। “দ্বৈত ব্যবহারের” ধোঁয়া তুলে সার, কীটনাশক প্রায়ই বিলম্বিত করা হতো চাষের মৌসুম চলে না যাওয়া পর্যন্ত। স্থগিত করা হতো ডেইরি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং ভেড়া ও ছাগল পালনের টিকাও। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে বিমান হামলা চালানো হয়েছিল তার ফলে ইরাকে অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ইরাকের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি এমন বিমান হামলা দেশটিকে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ইয়েল ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল জাস্টিস কর্মসূচির অধ্যাপক জয় গর্ডন তার তার লেখায় বলেন, ইরাকের উপর বিমান হামলা এবং নিষেধাজ্ঞার পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ‘ইরাকের পুনর্গঠনের মতো সম্পদ ছিল। কিন্তু দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং প্রায় বন্ধ থাকা আমদানি-রপ্তানির কারণে, ইরাক \'শিল্পযুগ-পূর্ব\' অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। আর এই অবস্থা চলছিল বছরের পর বছর। কম করে হলেও প্রায় এক দশক।’ নিষেধাজ্ঞার কারণে অপুষ্টি বেড়ে গিয়েছিল এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নানা ধরনের রোগের বিস্তার ঘটেছিল। মিজ গর্ডন ২০২০ সালে তার এক লেখায় উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে (২০২০ সালে) ইরাকের জনগণের মধ্যে যে অপুষ্টি দেখা যাচ্ছে তা আসলে নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ফুড এন্ড অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশন-এফএও এর এক গবেষণায় বলা হয় যে, ওই সময়ে ইরাকে জন্ম নেয়া প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ২০০ জনই মারা যেতো। এরপর ১৯৯৯ সালে ইউনিসেফ তাদের একটি গবেষণায় বলেছিল যে, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ইরাকে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রতিনিধি এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলেন জাটা বার্ঘার্ট। তিনি ইরাকে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। পরে তার এক লেখায় তিনি ইরাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লংঘনের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ইরাকের উপর যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তা ছিল মানব ইতিহাসে কোন দেশের উপর দেয়া সবচেয়ে কঠোর এবং দীর্ঘতম নিষেধাজ্ঞা। ইরাকে যে মানবিক কর্মসূচি চালানো হয়েছে তা আসলে দেশটির জনগণের মানবাধিকারকে রক্ষা করে না।’ ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের ডাব্লিউএফপি এবং এফএও এক প্রতিবেদনে বলে যে, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ক্রমাগত বঞ্চনা, মারাত্মক ক্ষুধা ও অপুষ্ঠির শিকার হয়েছে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী ও বুকের দুধ পান করানো নারী, বিধবা, এতিম, অসুস্থ, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীরাও এর বড় শিকার। ১৯৯৭ সালে কফি আনান বলেছিলেন যে, দেশটির ৩১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। খাদ্য নিরাপত্তা বাধাগ্রস্ত এবং অপুষ্টির এই চিত্র চলেছে ১৩ বছর ধরে। ওই সময়ে কত শিশু মারা গেছে তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে।