যে তিন নির্বাচনের দিকে চোখ বিশ্বের


চলতি বছর বিশ্বের অনেক দেশে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জাতীয় নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এর মধ্যে ৫টি নির্বাচন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনের ফল বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন রূপ দিতে পারে। এ তালিকায় রয়েছে নাইজেরিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশের নির্বাচন। এর মধ্যে নাইজেরিয়া ও তুরস্কে এরই মধ্যে নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন বিশ্বের চোখ বাকি তিন নির্বাচনের দিকে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় এ বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকেই বিজয়ী ঘোষণা করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। যদিও বিরোধীরা এ নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। আগে থেকেই নাইজেরিয়ার নির্বাচনে কারচুপি হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন নাইজেরিয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তিনি এক ঘোষণায় বলেন, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২০১২ (এ) (৩) (সি) ধারার অধীনে যেসব ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে বিশ্বাস করা হয়, তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এদিকে মে মাসে নির্বাচন হয়েছে তুরস্কে। জয় পেয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তুরস্কে এরদোগানের ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপক ভূরাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গোটা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের একমাত্র সেতু হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। পাকিস্তান ২০২২ সাল ছিল পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক ও জলবায়ু সংকটের বছর। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে ২০২৩ সালেও সংকট অব্যাহত রয়েছে। গত বছর দেশটির এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। এতে তিন কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক হাজার ৭০০ মানুষ। ওই বছরের শুরুতে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় মধ্যপন্থি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) শেহবাজ শরিফ। তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট, বন্যা এবং সন্ত্রাসী হামলার উত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে শরিফের সরকার। পাক সরকারের এই ব্যর্থতা নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করে রেখেছেন ইমরান খান। পাশাপাশি তিনি তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য বারবার মার্কিন ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। গত নভেম্বরে তাকে হত্যার চেষ্টাও চলে। যদিও এতে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তবে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই আগাম নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন ইমরান খান। অপরদিকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একাধিক দুর্নীতি মামলা। সে রকমই এক মামলায় গত ৯ মে গ্রেফতার করা হয়েছিল ইমরান খানকে। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানজুড়ে সামরিক বাহিনীর অবকাঠামো এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তিতে সহিংস আক্রমণ চালায় তার সমর্থকরা। ইমরান খান পরে মুক্তি পেলেও ৯ মের দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে তার দল ভয়াবহ চাপের সম্মুখীন হয়। একে একে দল ছাড়তে থাকেন বড় বড় নেতারা। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী এ বছরের ১২ অক্টোবরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। যদিও বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে সন্দিহান। তারা এই প্রশ্নের উত্তরেও বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে দিচ্ছেন। তবে একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত যে, পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। তাই নির্বাচন যত দ্রুত হবে, তার জন্য তত ভালো। আর্জেন্টিনা আগামী ২৯ অক্টোবর আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পাশাপাশি জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক গভর্নর নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে সেই সময়। এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির জনগণ চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে মাথায় রাখবে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ রেকর্ড একশ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। এখনো উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে সেখানে। বর্তমানে দেশটিতে ক্ষমতায় রয়েছেন মধ্য বামপন্থি জোট ফ্রেন্তে ডি টোডোসের নেতা আলবার্তো ফার্নান্দেজ। তিনি পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চলেছেন আর্জেন্টিনার রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ জাভিয়ের মিলি। তিনি রাজনৈতিক জোট লা লিবারতাদ আভাঞ্জার সম্ভাব্য প্রার্থী। মিলি নারীবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে, তিনি সব ধরনের করের বিরুদ্ধে। তিনি নিজেকে একজন পুঁজিবাদী রাজনীতিক হিসেবে বর্ণনা করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আর্জেন্টিনার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ডি কির্চনারকে হত্যার চেষ্টা চলে। তিনি একসময় আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কির্চনার সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তিনি আবারও শীর্ষ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কিন্তু গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। ফলে আর্জেন্টিনার সংবিধান অনুযায়ী, সরকারি কোনো দায়িত্বে নিয়োগ পাওয়া তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী রাজনীতিবিদরা অভিযোগ করছেন যে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অন্যায়ভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। সাংবাদিকরা বলেছেন যে, তারা নির্বাচনের সময় ‘ব্যালট স্টাফিং’ (বৈধ ভোটের থেকে অধিক ব্যালট কাস্ট) করতে দেখেছেন। এ ছাড়া ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগও রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৮ সংসদীয় আসনের ৯৫ শতাংশেরও বেশি আসনে জয় পেয়েছে। উড্রো উইলসন সেন্টারের এশিয়াবিষয়ক প্রোগ্রামের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এটি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এই সরকার কঠোর হাতে দেশ শাসন করে চলেছে এবং বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করতে তারা দ্বিধা করে না। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ থেকে শত শত বিরোধী সমর্থককে গ্রেফতার করার অভিযোগ রয়েছে। কুগেলম্যান সন্দিহান যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া নির্বাচন কমিশন আসলেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং শাসক দলের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হবে না। এ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে জাতীয় নির্বাচন। সেখানেই নির্ধারিত হবে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটবে নাকি গণতন্ত্র সংকুচিত হবে।