রাইসিই রাশিয়া–ইরান–চীনের ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’র পথিকৃৎ
অনলাইন নিউজ ডেক্স
সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে \'হাইব্রিড\' যুদ্ধ। এমন সংঘর্ষপূর্ণ অবস্থায় পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া, ইরান ও চীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে এই তিনটি দেশের মধ্যে। তারা ব্রিকস এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এই দুটোরই সদস্য। গত সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে তাদের এই সম্পর্ক আরও পরিষ্কার হয়ে এসেছে বিশ্বের সামনে। সংক্ষেপে বলা যায়, এই তিন মিত্রের সম্পর্ক বেশ শক্তপোক্ত। এদের মধ্যে একজনকে কেউ আক্রমণ করতে চাইলে বাকি দুই মিত্র হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
রাইসির অতীত সাফল্য
ইরানের নেতা হিসেবে সম্প্রতি নিহত প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান বড় ধরনের সাফল্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। তাদের শাসনামলেই ব্রিকস, এসসিও, এবং ইউরেশিয়া ইকোনমিক ইউনিয়নের সদস্যপদ পায় ইরান। বৈশ্বিক মেরুকরণের পরিধি বাড়াতে এই তিনটি সংস্থাই ভূমিকা রাখছে বর্তমানে।
রাইসির হাতে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক দিয়েও বিপুল প্রসার দেখেছে ইরান। বিশেষ করে আরব ও আফ্রিকার দেশগুলো- সৌদি আরব, কুয়েত, মিশর, লিবিয়া, সুদান, এবং জিবুতির সাথে ভালো হয়েছে তাদের সম্পর্ক। এছাড়া প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে বড় একটি হামলা চালায় ইরান।
এই সময়েই রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক আন্তরিক হয়ে ওঠে সামরিক ও বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই। বছর দুয়েক আগে রাইসি ও পুতিন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে সম্মত হন। চুক্তির কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে, ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের সই পেলেই আরও পোক্ত হবে এই দুই পরাশক্তির সম্পর্ক।
গত বছর মস্কোয় ইরানের এক প্রতিনিধি আমাকে বলেছিল, রাশিয়ানদের যখন জিজ্ঞেস করা হয় এই চুক্তির আওতায় কী থাকতে পারে, তারা বলেছিল, \"তোমরা (ইরান) যে কোনো কিছু চাইতে পারো।\" ইরানের পক্ষ থেকেও রাশিয়াকে একই প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এ থেকে বোঝা যায়, রাশিয়ার এশিয়ামুখি এবং রাইসির পূর্বমুখি কূটনীতি বাস্তবে রূপ নিচ্ছে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যমে।
পুতিন-জিনপিং যৌথ বিবৃতি
গত সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিন ও শি জিনপিং বৈঠকের পর ১০ অধ্যায় লম্বা এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। এতে অন্তত ১৩০ বার এসেছে \'সহযোগিতা\' কথাটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত বিশ্বব্যবস্থাকে এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছে এই বিবৃতি।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেছে গত কয়েক বছরে। রাশিয়া ও চীন বিভিন্ন কৌশলে এসব নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব এড়িয়ে গেছে, বাণিজ্য বজায় রাখতে ব্যবহার করেছে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। কীভাবে এমন পরিস্থিতি এড়াতে হয়, এই দুই দেশের থেকে তা শিখছে প্রায় চার-দশক ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান।
তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপের কোনো বন্দরই রাশিয়ার জাহাজ ঢুকতে দিচ্ছে না। রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক বন্দরে বড় মালবাহী জাহাজ নোঙর করতে পারে না, ওদিকে আবার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দরটি চীন থেকে বহুদূরে। এ সমস্যা এড়াতে রাশিয়া-চীনের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ আরও উন্নত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে।
রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যেও উন্নত হতে যাচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা। বিশেষ করে রাশিয়ার আস্ত্রাখান থেকে কাস্পিয়ান হ্রদে ইরানি বন্দর এবং স্থলভাগ দিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত চলাচলের সুবিধা করতে পারলে পুরো আরব অঞ্চলেই বাণিজ্য বাড়বে, এমনটাই বলেন ইরানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাঘেরি কানি। চীনে যে সফরে গিয়েছিলেন পুতিন, অচীরেও ইরানে একই ধরণের সফরে যেতে পারেন তিনি।
ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাইসির আকস্মিক মৃত্যু ছিল দুঃখজনক, তবে এতে রাশিয়া, চীন ও ইরানের গতিপথে কোনো বাধা পড়বে না বলে ধরে নেওয়া যায়। ২০১৩ সালে নিউ সিল্ক রোডস প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে যে প্রগতির সূচনা হয়, তা অব্যাহত থাকবে। নিউ সিল্ক রোডস এবং এর পাশাপাশি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) একদিক দিয়ে যেমন এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক চেহারা পাল্টে যাবে, তেমনি নতুন মাত্রা আসবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া-চীন সম্পর্ক গতিশীল হতে থাকে, এর পাশাপাশি ইরান সে দেশে উৎপাদিত প্রায় সব তেল চীনের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে ও ফলশ্রুতিতে চীনের নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে এসে পড়ে।
এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে পর পর কয়েক বছর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা দেখা যায়। প্রথমে আফগানিস্তান থেকে হঠানো হয় মার্কিনিদের। এরপর ২০২২ সাল থেকে শুরু হয় ইউক্রেন অভিযান। এর কিছু পরেই দক্ষিণের দেশগুলো থেকে সদস্য নিতে শুরু করে ব্রিকস। ২০২৩ সালে মস্কো সফরে গিয়ে শি জিনপিং বলেছিলেন, এমন সব পরিবর্তন আসবে যা গত এক শতাব্দীতেও দেখা যায়নি। আর এসব পরিবর্তনের অগ্রভাগে থাকবে চীন ও রাশিয়া। গত সপ্তাহে বেইজিং বৈঠকেও এই প্রসঙ্গই উঠে আসে।
নতুন দিকনির্দেশনা
জ্ঞান, সৃজনশীলতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, ক্ষমতা- কোনো দিক দিয়েই পিছিয়ে নেই রাশিয়া, চীন ও ইরান। এই তিন দেশের পক্ষেই সম্ভব বিশ্ব রাজনীতিতে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন আনা। এই তিন দেশের নেতারা তা জানেন এবং বোঝেন। আর এই বোঝাপড়া নিয়েই তারা নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা তৈরির পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন।
অতীতে পশ্চিমাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। সেই নীতি থেকে সম্পূর্ণ উল্টো ঘুরে শক্তিশালী এক ইরান গড়ে তোলেন রাইসি। রাইসির পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে সাঈদ জালিলিকে। পশ্চিমারা জালিলিকে অতিরিক্ত উগ্রপন্থী বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট স্থলাভিষিক্ত হলে তিনিই হয়ে উঠতে পারেন পুতিন-জিনপিং এর পাশে দাঁড়ানোর মতো যোগ্য এক মিত্র।
পেপে এসকোবার: ইউরেশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক; দি ক্রেডল থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর করেছেন কে এন দেয়া
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।