রাজনৈতিক সমাধান বড়ই প্রয়োজন!
মোঃ রাছেল রানা, প্রধান সম্পাদক
কোটা আন্দোলন ছিল একটি সহজ এবং সরল অঙ্ক। যে অঙ্কের সমাধান ৯০+১০=১০০ অথবা ৯৫+৫= ১০০ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই অঙ্কের সমাধানে কি করে ৯৩+৭+ রক্তপাত+সহিংসতা+ অস্থিরতা=১০০ করার প্রয়োজন হলো বা করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তা একমাত্র বিধাতাই বলতে পারেন। হ্যাঁ, কোটার ভাগ শেষ হয়েছে; কিন্তু সমীকরণের সেই অস্থিরতার হিসাব এখন প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই কথা বলছে, বিচার চাচ্ছে! ক্ষোভের মাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ছে। দাবি-দাওয়ার মাত্রাও পরিবর্তিত হচ্ছে। মিনিটে মিনিটে ফেসবুক এবং সোশ্যাল-মিডিয়া সরকারের বিরুদ্ধে প্ররোচনায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। তবে বড় সমস্যা হচ্ছে, অনেক স্থানে আবারও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যা নিয়ে দেশবাসী আবারও শঙ্কিত।
কোটা নিয়ে ইতোমধ্যে দেশে যে রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটেছে, তা আমরা কম বেশি সবাই জানি। আমরা স্বীকার করি বা না করি, এ নৃশংস ঘটনার জন্য আমরা অনেকেই কম বা বেশি দায়ী। হ্যাঁ, সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এ সহজ অঙ্ক জটিল হয়েছে, একটি অহিংস আন্দোলন সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিরোধীদলও সরকারের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা আবেগে বা কিছু লোকের ইন্ধনে বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং কেউ কেউ সহিংসতায় যোগ দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে।
সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, সরকার বিশাল ছাত্রসমাজকে কাছে টেনে না নিয়ে, বরং প্রতিপক্ষ হিসাবে তাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখন সরকার বলছে বিরোধীরা যোগ না দিলে এ অস্থিরতার সৃষ্টি হতো না। সরকার হয়তো বা ঠিকই বলছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিরোধীদল অনেক দিন থেকেই ভোটের বাইরে। তাদের অনেক নেতা-নেত্রী এখনো জেলে, তাদের আন্দোলনের পথ রুদ্ধ। জামাতে ইসলামীর রাজনীতিও তো বন্ধ করা হলো। এ রকম একটি শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন তারা এ গণদাবির পক্ষে কাজ করবে না? সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই এ আন্দোলন বন্ধ করা। তা না করে তারা এ আগুনের গোলা ছেড়ে দিয়েছে অন্যের হাতে। এ ব্যর্থতা কার? সরকারের না সরকার বিরোধীদের?
অনেকেই মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি শুধু কোটা আন্দোলনের জন্যই তৈরি হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ। সরকার উন্নয়ন করেই ব্যস্ত ছিল। জনগণের সুখ-শান্তি, অভাব-অভিযোগ ইত্যাদি ছিল উপেক্ষিত। হ্যাঁ, সরকার বা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ভুল করেছে। তাদের ভুলের কারণেই মানুষ সরকারকে প্রশ্ন করছে, বিচার চাচ্ছে! মানুষ চাইবে এবং চাইতেই পারে; কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা যা চাচ্ছি তা পাব কিনা। সরকার বলছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তারা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী বলছেন গণভবনের দরজা খোলা, আন্দোলনকারীরা আসুক, আমি তাদের কথা শুনতে চাই। আমি সংঘাত চাই না। ওদিকে, আন্দোলনকারীরা বলছে তারা আলোচনায় বসবে না।
নানা কারণেই আন্দোলনকারীদের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। তাই হয়তো তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ। কিন্তু আলোচনায় না বসলে এ সমস্যার সমাধান আসবে কোথা থেকে? কারও না কারও সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তো আলোচনায় বসতেই হবে! আলোচনায় না বসে সরকার ভুল করেছিল। যার ফলাফল আমরা সবাই জানি। এখন সরকার নমনীয় কিন্তু আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসতে চাচ্ছে না। আলোচনায় বসলে ক্ষতি কি? এখনো শেখ হাসিনাই দেশের সরকারপ্রধান! তার সঙ্গে তো আলোচনায় বসা যেতেই পারে। এমনকি আন্দোলনকারীরা যদি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়, সেটিও তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে সম্মানের সঙ্গেই তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারে।
তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাইলে আন্দোলনকারীদের অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। শেখ হাসিনা কার কাছে পদত্যাগ করবে? তার পদত্যাগের পর দেশ চলবে কীভাবে? দেশ কি আওয়ামী লীগের অন্য কেউ পরিচালনা করবে? না কী অন্য কোনো ব্যক্তি পরিচালনা করবে? দেশে কি নতুন কোনো সরকার গঠিত হবে? সেই সরকার কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে? নাকি অনির্বাচিত কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে? যদি ভোট হয়, তবে সেই ভোট কে পরিচালনা করবে? আর যদি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা দেশে আপৎকালীন সরকার গঠিত হয়, তবে সেই সরকারের কাঠামো কে ঠিক করবে? শুধু কি তাই, নতুন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও ভাবতে হবে।
আন্দোলনকারীদের বলছি, আন্দোলনের সময় অনেকে অনেক কথাই বলে। তবে সমাধান খুঁজতে গেলে আবেগ ও ক্ষোভ পরিহার করা খুবই জরুরি। ক্ষোভ ও আবেগের কারণেই দেশ আজ এ বিপদের সম্মুখীন। সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, ইচ্ছা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যায়। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, আলোচনার পথ পরিহার করে আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন করতে গেলে হয়তো দেশে আবারও অরাজকতার সৃষ্টি হতে পারে। এমনিতে বর্তমানে পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে। কে কী বলছে, কে কাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে; তার কোনোই ঠিক নেই। সে ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে দেশে যে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না, সে কথা কি বলা যেতে পারে?
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা কী চাচ্ছে? দাবি আদায় নাকি অরাজকতা সৃষ্টি? দেশবাসী মনে করে তাদের সন্তানরা দেশকে একটি ভালো দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছেন; কিন্তু তার মানে কি এই যে, জনগণ দেশে আর একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখতে চাচ্ছে? না, সাধারণ মানুষ শান্তি চায়! সাধারণ মানুষ কখনোই এ আন্দোলনকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে দেখতে চায় না! আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আবারও যদি অরাজকতার সৃষ্টি হয়, তাহলে কেউ না কেউ পরিস্থিতির সুযোগ নেবে বা নিতে চাইবে। তখন হয়তো অনেক কিছুই আন্দোলনকারীদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে বা যেতে পারে।
আন্দোলনকারীদের আবারও বলছি, দয়া করে ব্যক্তিগত হুমকি প্রদান থেকে বিরত থাকুন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। হ্যাঁ, এ দায়িত্ব পালনে হয়তো অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে অনেক কিছুই বলা যায়; কিন্তু অনেকের হয়তো কিছুই করার ছিল না। তার মানে কি এই যে, এখন তাদের অপমান করতে হবে? যে কোনো আন্দোলনের সফলতার জন্য শৃঙ্খলা অতীব জরুরি এবং আন্দোলনকারীদের এ শৃঙ্খলা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। গণআদালতে এখনই কি সব কিছুর বিচারের প্রয়োজন আছে? দেশে আইন আছে, সেই আইনেই দোষীদের বিচার করা সম্ভব।
কথা বলুন! আপনাদের দাবির কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলুন। দেখুন না কি হয়! অনেক হয়েছে, আমরা দেশবাসী আর রক্ত দেখতে চাই না। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ দেশ দেখতে চাই। আমি সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিনীতভাবেই বলছি, অনেক ভুল হয়ে গেছে, আর ভুল না করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দেশের জন্য যা মঙ্গলকর সেই ব্যবস্থাই গ্রহণ করুন। সবাই যদি চায় তবে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করুন। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সাহসিকতার ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
ড. এমএলআর সরকার : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
lrsarker@yahoo.com
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।