শিক্ষামন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে চাই


স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের শুরুটা মোটামুটি ভালোই ছিল। ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর প্রবাসী সরকার দেশে ফিরে নতুন করে মন্ত্রীদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করে। ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসূফ আলীকে। তিনিই স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী (১৯৭১-১৯৭৫)। মন্ত্রী হিসাবে তার মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা বলতে গেলে প্রশ্নাতীত। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি প্রবাসী সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। গণপরিষদের স্পিকার হিসাবে মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসূফ আলী। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।

দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে একনাগাড়ে সাড়ে তিন বছর তার দায়িত্ব পালন, কম কথা নয়। স্বাধীনতার পর প্রথম বিশ বছরে (১৯৭১-১৯৯১) মোট ২২ বার এ পদটিতে রদবদল হয়, বিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ইউসূফ আলী। তার মানে অধ্যাপক ইউসূফ আলীই স্বাধীনতার প্রথম বিশ বছরে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষামন্ত্রী।

দীর্ঘমেয়াদি, আবার স্বল্পমেয়াদি শিক্ষামন্ত্রী। এ নিয়ে রয়েছে নানা কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড তথা পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর এবং সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণ পর্যন্ত একে একে মোট সাতজন ব্যক্তি শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মানে সাত বছরে (১৯৭৫-১৯৮২) সাতজন শিক্ষামন্ত্রী। এ সাতজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টার মধ্যে একজনের মেয়াদ ছিল ৪০ দিন আর একজনের তিন মাস। স্বল্পমেয়াদি উল্লিখিত দুজন ছাড়াও একজন সাত মাস এবং আরও একজন এক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। কথা হলো, সাত বছরে ৭ জন শিক্ষামন্ত্রী দিয়ে প্রাত্যহিক কাজের বাইরে প্রকৃতপক্ষে কাজের কাজ কী হয়েছে কিংবা কতটুকু কাজই বা করা সম্ভব? সদ্যস্বাধীন একটি দেশে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বের এমন ঘন ঘন হাতবদলে জাতি আসলে কী পেয়েছে। অথচ মত আর পথ যাই হোক, মেধা ও পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা-বিচক্ষণতার বিবেচনায় অধ্যাপক আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী জাফর আহমদ ও শাহ আজিজুর রহমানরা কিন্তু কোনো অংশে কম ছিলেন না।

এ তো গেল পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়কার কথা। পরবর্তীকালে কী হলো, আশির দশকে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাল, লয় ও ছন্দপতনের ভয়াবহ পরিস্থিতি দারণভাবে নিরাশ করেছে গোটা জাতিকে।

১৯৮৬ সাল। মানে একটি মাত্র বছর। তার মানে ১২ মাস। আর দিনের হিসাবে ৩৬৫ দিন। উল্লিখিত এ এক বছরে (১৯৮৬) মোট পাঁচজন ব্যক্তি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শামসুল হুদা চৌধুরী থেকে শুরু করে মোমিনউদ্দিন আহমেদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী পাঁচ শিক্ষামন্ত্রীর (এক বছরে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে) মধ্যে কেউ পাঁচ মাস, কেউ আড়াই মাস, এমনকি কেউ দুই মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন। ডা. এমএ মতিন দুই দফায় (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬-২৩ মার্চ ১৯৮৬ এবং ২৫ মে ১৯৮৬-৯ জুলাই ১৯৮৬) আড়াই মাসের জন্য ছিলেন দেশের শিক্ষামন্ত্রী। এছাড়া একেএম নূরুল ইসলাম দুই মাসের (২৪ মার্চ ১৯৮৬-২৫ মে ১৯৮৬) এবং মোমিনউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাঁচ মাস (৯ জুলাই ১৯৮৬-৩০ নভেম্বর ১৯৮৬) মেয়াদের শিক্ষামন্ত্রী। এমএ মতিন, একেএম নূরুল ইসলাম এবং মোমিনউদ্দিন আহমেদ ছাড়া ১৯৮৬ সালে দায়িত্ব পালনকারী অন্য দুজন শিক্ষামন্ত্রীর নাম শামসুল হুদা চৌধুরী (৪ আগস্ট ১৯৮৫-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬) ও মাহবুবুর রহমান (৩০ নভেম্বর ১৯৮৬-২৭ মার্চ ১৯৮৮)।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে কী যে অরাজকতা, নৈরাজ্য আর খামখেয়ালিপনা সংঘটিত হয়েছে, তা অল্পকথায় বলে শেষ করা যাবে না। সাত বছরে (১৯৭৫-১৯৮২) ৭ জন কিংবা মাত্র এক বছরের মধ্যে (১৯৮৬) একের পর এক পাঁচজন শিক্ষামন্ত্রী। দুনিয়ার ইতিহাসে কোথাও এমন নজির আর আছে কিনা আমার জানা নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো দেশে এমন অপরিণামদর্শিতা সচরাচর লক্ষ করা যায় না। আহা, কী তামাশাটাই না করা হয়েছে শিক্ষার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে! জানি না এমন খামখেয়ালিপনার জন্য জাতি আমাদের ক্ষমা করেছে কিনা বা ভবিষ্যতে ক্ষমা করবে কিনা।

কেবল ‘বাগাড়ম্বর’ নয়, এমন অনেক কালজয়ী কবিতা লিখে অমর হয়ে রয়েছেন মহাজন কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদার (১৮৩৭-১৯০৭)। প্রসিদ্ধ এ কবিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তার ‘বাগাড়ম্বর’ শিরোনামীয় কবিতাটি উল্লেখ করতে চাই :

‘যেরূপ করিবে কাজ কার্যেতে দেখাও,

বৃথা গর্বে কেন তাহা কহিয়া বেড়াও?

না পার করিতে যদি কর যাহা গান,

কোথায় পাইবে লজ্জা রাখিবার স্থান?’

মানুষ তার কাজের মাঝেই বেঁচে থাকে। কম দিন আর বেশি দিন বলে কথা নয়, দায়িত্ব দায়িত্বই। বেশি দিন দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কাছে প্রত্যাশাটা থাকে বেশি। ব্যক্তির নাম, ঘটনা কিংবা বিষয়ের শিরোনাম উল্লেখ করতে চাই না। অতীতে শিক্ষা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাগাড়ম্বর আর অতিশয়োক্তিই সার; এক্ষেত্রে বারবার আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তারুণ্যদীপ্ত আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বেশ সুন্দর সুন্দর আশাজাগানিয়া কথা বলছেন। যদিও আমাদের অতীত বা নিকট-অতীত খুব সুখকর নয়। তবু আমরা তার কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। জানি না আবার কী এবং কেমন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমরা সুন্দর আগামী দেখার অপেক্ষায় রইলাম। মন্ত্রীর জন্য অনেক শুভকামনা।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক