শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে


স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেবল দেশেই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা হবে। তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে। কেবল শেখ হাসিনাই নয়, মামলায় হুকুমের আসামি হবেন আরও অনেকেই। সেইসঙ্গে পুলিশের পদস্থ যেসব কর্মকর্তা গুলির নির্দেশ দিয়েছেন, যারা মাঠে থেকে নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন তারাও পার পাবে না। পরিবর্তন করা হবে পুলিশের লোগো এবং পোশাক। ভবিষ্যতে কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ কাজ করবে না। পুলিশ পরিচালনা করা হবে একটি কমিশনের মাধ্যমে। শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কমিশন গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাহার করা হবে প্রাণঘাতী সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু। সোমবার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ অফিস কক্ষে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার পক্ষে এখন ভারত ছাড়া আর কেউ নেই। তারা যদি বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষেই অবস্থান ধরে রাখেন তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী-জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাকচার ভেঙে পড়েছে। এটা ঠিক করাই মূল চ্যালেঞ্জ। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলির বিষয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এক বড় একটি ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এতে মানুষের মনে বাহিনী সম্পর্কে একটি ঘৃণা জন্মেছে। এতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অনুতপ্ত। তারা আমাকে বলেছে, তাদের দিয়ে অপকর্ম করানো হয়েছে। নিজেরা এখন ঘৃণার পাত্র হয়ে গেছেন। এর দায় সিনিয়র অফিসার ও অন্যদের। তাই বর্তমান ইউনিফর্ম পরে ডিউটি করতে চাচ্ছে না। তারা এখনো ট্রমার মধ্যে আছে। আমি আমার ব্যক্তিগত ইমেজ দিয়ে আপাতত পুলিশের সমস্যার সমাধান করেছি। কিন্তু পুরো স্ট্রাকচারকে একটি পর্যায়ে আনতে একটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে নিহত ৫৭ সেনা কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার কোনো কূলকিনারা হয়নি। আমি এই দুটি ঘটনার শেষ দেখতে চাই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। আরও জানান, পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন আনসার সদস্যরাও। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি কোনো আরাম-আয়েশের জন্য উপদেষ্টা হইনি। যে যাই বলুক না কেন, আমি আমার কাজ করতে চাই। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে চেয়ারে বসতেন সেই চেয়ার পরিবর্তন করে ফেলেছি। আমি একটি নরমাল চেয়ারে বসি। যে টেবিলটি রয়েছে সেটিও সরিয়ে ফেলব। অতীতে এই চেয়ারে বসে অনেক অন্যায় কাজের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমি সেসব করতে চাই না। যারা অপকর্ম করেছেন তাদের সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ যেসব কর্মকর্তা বিদেশে পলাতক তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। অপকর্মের হুমুকের আসামি, হুকুম বাস্তবায়নের ইমিডিয়েট অফিসার, যারা ফারদার অর্ডার দিয়েছে, মাঠে যারা বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের গুলি করতে বলেছে, লোড করতে বলেছে- তাদের সবার বিরুদ্ধেই তদন্ত হবে। এটা একটি বড় ধরনের অনুসন্ধান। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি মানবাধিকার লংঘনের অনুসন্ধান হবে। এর আগে জাতিসংঘ বলেছিল, তদন্তে কোনো সহযোগিতা লাগলে তারা করবে। আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিসংঘের সহায়তা চাইব। হুকুমের যে বিষয়টা আছে, সে বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিঠি লেখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কারা কারা হুকুমদাতা তাদের তালিকা করা হবে। এ বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত মেধাবী। কখন কোথায় কী করতে হবে সে বিষয়টি তারা বোঝে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ছয় সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি কালেকটিভ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ সুযোগসন্ধানী মহলকে দেশের বাইরে থেকে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধেও প্রোপাগান্ডা চলছে। যারা কিছুদিন আগে এ দেশ শাসন করেছে তাদের সঙ্গে ছিল কেবল ভারত। ইন্ডিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিলে ভুল করবে। তারা লুজার হবে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় অনেক দেশ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, অন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হলে শেখ হাসিনাকে বিচারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবে ভারত। আমাদের দেশে মামলা হলেও তাকে বিচারের আওতায় আসতে হবে। তিনি দোষী হলে কি ভারত তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে না? শেখ হাসিনা কী চেয়েছিলেন, তা আমাদের বুঝতে হবে। ক্ষমতা ছাড়ার দিনও গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন আরও মারো। ওইদিনও অনেককে হত্যা করা হয়েছে। তাই আমি মনে করি, তাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে। কেবল তিনিই নন, তার আশপাশে যারা ছিলেন তাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনি (হাসিনা) শেষের দিকে বলেছেন. পুলিশ কাউকে হত্যা করেনি। হত্যা করেছে দুষ্কৃতকারীরা। তাহলে আমার প্রশ্ন, কজন দুষ্কৃতকারীকে আপনারা ধরেছেন? কজনের কাছ থেকে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু অস্ত্র উদ্ধার করেছেন? এই অস্ত্র তো পুলিশের হাতে। এই গুলিতে আহত হয়েছেন আনসার সদস্যরাও। পুলিশের কাছ থেকে এই মারণাস্ত্র উঠিয়ে নেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অস্ত্র পুলিশ ব্যবহার করতে পারে না। বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, পুলিশের সংস্কারের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। পুলিশ চলবে পুলিশ কমিশনের মাধ্যমে। আমরা পুলিশ কমিশন গঠন করব। এর আগে একবার কমিশন গঠিনের প্রস্তার দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে। এবার সেই প্রস্তাব এলে গ্রহণ করা হবে। পুলিশে এখন যে লোগো আছে সেটি একটি পার্টির লঘু। তাই এ লোগো থাকবে না। পুলিশ নিজেই এই লোগো নিয়ে বের হতে চায় না। আমরা বলেছি, আমাদের একটু যৌক্তিক সময় দিন। সব ঠিক করে দেব। পুলিশের আবাসন সমস্যা, জনবল সমস্যা এবং নিজস্ব থানা ভবন তৈরিসহ যেসব দাবি আছে সেগুলো আমাদের এজেন্ডার মধ্যে আছে। নিশ্চয় এসব সমস্যার সমাধান হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর যত দুর্নীতি-অনিয়ম হয়েছে সবকিছুর বিচার হবে। এ বিষয়ে দুদককে বেশি অ্যাকটিভ হতে হবে। তাদের জনবল বাড়াতে হলে বাড়াব।