সংকট নিরসনে সংলাপ জরুরি


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে দেশের রাজনীতি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। ক্ষমতাসীনরা বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অন্যদিকে বিরোধীদের দাবি, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সবমিলিয়ে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। আর এ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিদেশি পরাশক্তিগুলো যে যার স্বার্থে বিভিন্ন ফর্মুলা দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত জুড়ে দিয়ে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। নিজেদের ভুলের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এর সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে অতীতে কোনো দেশেই জনগণের স্বার্থ সুরক্ষায় সফল হতে পারেনি। এ কারণেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন (ইসি), নির্বাচন পর্যবেক্ষক, সুশীল সমাজ, পেশাজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ করা জরুরি। এর মাধ্যমে সর্বজন গ্রহণযোগ্য পন্থা বের করা এখন সময়ের দাবি। আর সংকট উত্তরণে নিজেরা ব্যর্থ হলে এই মুহূর্তে বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে-এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এদিকে সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমন্বয়হীন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনরা বলছেন, দলীয় ফোরামে আলোচনার পরই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত। তা না হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এজন্য আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানেরই সুনির্দিষ্ট মুখপাত্র থাকা দরকার। প্রসঙ্গত, সংলাপ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমুর ইতিবাচক বক্তব্যে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা পায়। গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে-তার এমন বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় সব মহল। সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীও সংলাপ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানান। তবে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। এ ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীরা সমন্বয়হীন বক্তব্য দিতে থাকেন। আমির হোসেন আমু নিজেও তার বক্তব্য থেকে সরে যান। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। এদিকে সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এমন বক্তব্যের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার যদি বলে পদত্যাগ করব, তখন আলোচনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সব প্রতিষ্ঠানেরই একজন মুখপাত্র থাকলে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য আসে না। একটাই বক্তব্য আসে। সবাই ধরে নেয় সেটা তাদের বক্তব্য। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ কম থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত তাদের সাধারণ সম্পাদকের ওপরই এই দায়িত্ব দেয়। তিনি দলটির মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেন। এভাবেই হয়। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে সবাই কথাবার্তা বলবেন এটা তাদের অধিকার। রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতা অবশ্যই কথাবার্তা বলবেন কিন্তু তাদের বক্তব্যে সমন্বয় থাকলে ভালো হয়। এটা হলে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা কম হয়। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, সামনে নির্বাচন। এখন কথাবার্তায় মনে হচ্ছে হয়তো তারা সংলাপে বসবে না। কিন্তু একটা সময় সংলাপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন। একসঙ্গে নিয়েও কথা বলছেন। ফলে সংলাপ যে একেবারেই হচ্ছে না সেটাও বলা যায় না। সংলাপ বলতে শুধু আওয়ামী লীগ বিএনপির সংলাপ নয়। নির্বাচন কমিশন, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী, নির্বাচন পর্যবেক্ষকসহ সবার সঙ্গে সংলাপ হতে হবে। সেই সংলাপটাই লাগবে। এটা কোন সময়, কোন ফরমেটে হবে, কারা বসবেন-এই বিষয়গুলো হয়তো স্পষ্ট হতে আরেকটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এই মুহূর্তে তাদের কৌশল উন্মুক্ত করতে চাইবেন না। ফলে একটা ধোঁয়াশা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। খবরের পেছনে যেমন খবর থাকে, তেমনি সংলাপের পেছনেও সংলাপ থাকে। এখন হয়তো অনেক রাজনৈতিক দলই সংলাপের কথা অস্বীকার করছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হয়তো সংলাপের প্রক্রিয়া চলছে। কারণ রাজনীতি খুবই গতিশীল প্রক্রিয়া। আমরা ইচ্ছে করলেও এটাকে স্থবির করে রাখতে পারব না। রাজনীতি তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। রাজনৈতিক দলগুলোও সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, একটি দলীয় ফোরামে আলোচনা করেই তাদের বক্তব্য প্রকাশ করবে এটা স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় এ ধরনের স্ট্যান্ডার্ড বা ডিসিপ্লিন আমরা আনতে পারিনি। আমাদের নেতা ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন রকমের কথা বলেন। আবার বলেন, এটা ব্যক্তিগত মতামত। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার একটি নজির। এটি নতুনও নয়, এটি চলছে। কিন্তু আমরা এটি ঠিক করতে পারছি না। ফলে অনেক সময় আমরা সাধারণ মানুষ বা পেশাজীবীরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। এর মধ্য দিয়েই কিন্তু সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনাস্থা গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এটি ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক দলের স্পোকম্যান থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদকেরই পার্টির স্পোকম্যান হওয়া উচিত। কিন্তু ক্যামেরা দেখলে যে বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই, সে বিষয়েও কথা বলে ফেলি। গণমাধ্যম কর্মীদেরও কাকে, কোথায়, কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতে হবে- তা সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এটি হয় না। দেখা গেল-বৃক্ষরোপণের অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয় রাজনীতি নিয়ে। ফলে নেতা-মন্ত্রীরাও ফোরামে আলোচনা বা সিদ্ধান্তের আগেই নানা ধরনের মন্তব্য করে ফেলেন। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, আমরা এখন এমন একটি বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক বা কূটনৈতিক যে কোনো সমস্যা টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা জাতিগতভাবে সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের অতীত ইতিহাস যদি দেখেন আলোচনা বা সংলাপ যেগুলো হয়েছে তা কার্যকর হয়নি। সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার, জাতি হিসাবে আমরা সেটা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। এখানে রাজনৈতিক দলের দায় বেশি। তিনি আরও বলেন, আমি আবারও বলছি, আমাদের সমস্যার সমাধান সংলাপের মাধ্যমেই হতে হবে। কিন্তু দুই দলের অনড় অবস্থানে মনে হচ্ছে না আমরা সেখানে যেতে পারব। জানতে চাইলে সু-শাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আসলে আমরা তো রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করছি। রাজনীতি হলো আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় ও ছাড় দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং সমস্যার একটা যৌক্তি সমাধানের প্রক্রিয়া। কিন্তু এটি এখন হয়ে গেছে অপরাজনীতির প্রক্রিয়া। যা আমার কাছে বোধগম্য নয়। আমি মনে করি, আলাপ-আলোচনা ছাড়া কোনো কিছুরই স্থায়ী সমাধান হয় না। জোর করে রাজপথে সাময়িকভাবে বিজয় অর্জন করা যায় কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। তিনি আরও বলেন, আমি আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদদের বোধোদয় হবে। জনগণের কল্যাণে জনস্বার্থেই সংলাপ হওয়া দরকার। সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। তা না হলে সম্ভাব্য যে সহিংসতা তা কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। নেতাদের সমন্বয়হীন বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের পুরো রাজনীতিই আর জনকল্যাণের নয়। এটি হয়ে গেছে ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে, কোটারি স্বার্থে। জনগণের কল্যাণের নামে এগুলো করা হয়। ফলে আগে এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্যই পরিবর্তন হওয়া দরকার। এটি হওয়া উচিত জনকল্যাণের জন্য। তা না হলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।