বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই। আলাপ-আলোচনা ও গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে এ সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তাঁরা এ মত দেন।
বিশিষ্টজন বলেন, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আলোচনা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সৃজনশীলতা ছিল। তবে সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়েছে। নাগরিকদের অধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতাও রয়েছে প্রশ্নের মুখে। এ বিষয়গুলো ভয় ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
তাঁরা বলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে লাভ হবে না, যদি রাজনীতিকরা না পাল্টান। নির্বাচন ঘিরে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষেরও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি রয়েছে আস্থাহীনতা।
মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন। বিইআইর সিনিয়র উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত সোহরাব হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিইআইর প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। মতবিনিময় সভাটিতে যৌথভাবে সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)।
মূল প্রবন্ধে এম হুমায়ুন কবির বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টায় এ মতবিনিময় প্রাথমিক পদক্ষেপ। আমাদের গবেষণায় তৃণমূলের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের তরফ থেকে তিন রকমের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তা হলো– আশাবাদ, হতাশা ও প্রত্যাশা।
তৃণমূলের আশাবাদ নিয়ে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তৃণমূল স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আশাবাদী। সেই আশাবাদ থেকে প্রেক্ষাপট দেখতে চায় তৃণমূল। বাংলাদেশে সৃজনশীলতায় বিশ্বাস করে তৃণমূল। যে কোনো সমস্যা সৃজনশীলতার সঙ্গে সমাধান সম্ভব বলে মনে করে তারা। সমস্যা সমাধানে তারা আলাপ-আলোচনায় উদ্যোগী হতে প্রস্তুত এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী।
তৃণমূলের হতাশা তুলে ধরে সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ সংকীর্ণ হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি কমে যাচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে, বেড়েছে দুর্নীতি এবং রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব বেড়েছে, যা নাগরিক অধিকারকে খর্ব করেছে।
তৃণমূলে ভয়ের সংস্কৃতি নিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অংশীজনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও আশঙ্কা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর মধ্যে হয়রানির ভয়; অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিঘাতের শঙ্কা রয়েছে।
এম হুমায়ুন কবির বলেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার ব্যাপারে অনেক অংশীজনের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে সংশোধন ও আরও শক্তিশালী করা জরুরি। অংশীজনের অভিযোগ, জনস্বার্থের বিষয়ে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের সম্পৃক্ততা কম। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে।
মতবিনিময়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংসদে ৬০ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী। যাঁরা নমিনেশন বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে এসেছেন। বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যবেক্ষক এনে লাভ হবে না। কারণ, পর্যবেক্ষকরা যতক্ষণ প্রতিবেদন দেবেন, ততক্ষণে সরকার গঠন হয়ে যাবে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে এবং আগামী নির্বাচনের আগে আস্থা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। মহাপরিক্রমশালী সরকারকে নিরপেক্ষ করতেই হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচন আমরা কী দেখেছি? বিরোধীরা সুযোগ পায়নি প্রচারণায়। গাইবান্ধায় যাঁরা নির্বাচনে অনিয়ম করেছেন, তাঁদের ফৌজদারি অপরাধী করার নিয়ম থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গণতন্ত্র একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া। ১৯৯৬ সালে যেমন একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছিল, ঠিক তেমনি নতুন করে একমতে যেতে হবে। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে, যত দিন না বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হয়।
গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বলেন, গাইবান্ধায় ১৩৪ জন অনিয়ম করেছে। তবে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা কীভাবে রাখা যায়। আমার তো তাদের ওপর আস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে।
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ও সংসদ সদস্য শামীম হায়দায় পাটোয়ারী বলেন, আমরা ভয়াবহ সংকটে আছি। স্বল্পোন্নত আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ, আমাদের কোনো সুফল দেবে বলে মনে হয় না; বরং ঝুঁকি বাড়াবে। তিনি বলেন, রাজনীতিকে ক্ষমতাসীনরা এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, আবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। জাতীয় পার্টির এ সংসদ সদস্য আরও বলেন, জাতীয় সংলাপ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারকে নিজে থেকেই জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা উচিত।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী বলেন– দলীয় সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং সামরিক সরকার, নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বিষয়ে বাংলাদেশে সব ধরনের সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যবস্থাগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণে জাতীয় সরকার গঠন করে এর অধীনে নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অপরাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার সুপারিশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে বিশ্বাসের সুযোগও থাকে না। বিকল্প যখন বিশ্বাসযোগ্য হয়, তখন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আইনি সমস্যা রয়েছে। সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নির্ভুল ভোটার তালিকা ছিল। এখন আবারও ভোটার তালিকা সঠিক করতে হবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বাংলাদেশ এখন আইনের শাসনের কার্যকারিতা হারিয়েছে। দেশে এখন ন্যায়বিচারের শাসন দরকার।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই জানিয়ে আর্টিক্যাল ১৯-এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গেলে জনগণের খবর রাখেন না। জনগণের কথা রাজনীতিবিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি হচ্ছে গণমাধ্যমের। শ্রীলঙ্কায় নতুন এক আন্দোলন শুরু হয়েছে ‘আঙ্কেল গো’। বয়স্ক রাজনীতিবিদদের যাঁরা জনগণের সঙ্গে নেই, তাঁদের জন্য এ আন্দোলন।
জনগণের ওপর রাজনীতিকদের আস্থা নেই বলে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারছি না। বর্তমানে সংলাপের বিকল্প নেই। আর নির্বাচন সমাধান এনে দেবে না। গণতান্ত্রিক চর্চা সমাধান এনে দিতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করে এবার চালানো যাবে না। নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি, একসঙ্গে বসেন, আলোচনা করেন। দলগুলোর ওপরের পাঁচজনকে নিয়ে বসেন।
আইন ও সংবিধানের মধ্য থেকে পরামর্শ দিতে বলেছেন যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, আলোচনা হতে পারে। ফর্মুলা দেন, যদি থাকে।
বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের মুখপাত্র মো. আলী ফারুকি জাতীয় সংলাপের পাশাপাশি আনুপাতিক হারে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বাধ্য করার মধ্যে অহমিকা আছে। আওয়ামী লীগ পারে, বিএনপি পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনায় গুরুত্ব দেয় কিনা– তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।