সক্রিয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীরা, চলছে নীরব চাঁদাবাজি


রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছে ফেব্রুয়ারি মাসে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান পরিচয়ে দুই দফায় ফোনে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। চাঁদার টাকা না দিলে বাসায় গিয়ে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি থানায় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই ব্যবসায়ী। জিডি নম্বর ১২৫৮। এ হুমকির পর কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে চলে যান তিনি। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বলেন, মাঝেমধ্যেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম করে চাঁদা চাওয়া হয় তার কাছে। সম্প্রতি হুমকি-ধমকি বেশি পাচ্ছেন। পরিবার নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছেন। ধানমন্ডি থানা পুলিশ বলছে, সম্প্রতি থানায় একই ধরনের আরও কয়েকটি জিডি হয়েছে, যার তদন্ত চলমান আছে। সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেফতার কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, বাড্ডা ও আশপাশের রামপুরা-খিলগাঁও-শাহজাহানপুরের এক সময়কার ত্রাস তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান আহমেদ মন্টি বর্তমানে দুবাইয়ে আত্মগোপনে আছে। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী। সম্প্রতি এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী দুবাইয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠকে তাদের অনুসারীদের বাড্ডা-ভাটারা এলাকায় চাঁদা তুলে চাঁদার টাকার ভাগ তাদের পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী ওরফে কলিংসের অনুসারী পরিচয়ে রাজধানীর পশ্চিম মেরুল বাড্ডায় এক রেস্তোরাঁ মালিকের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই রেস্তোরাঁতে ভাঙচুর চালায় সন্ত্রাসীরা। মিরপুর এলাকায় শাহাদত বাহিনীর সদস্যরাও সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সক্রিয় হয়েছে। দুবাই থেকে শাহাদত মিরপুর এলাকায় তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক ব্যবসায়ী নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন। সূত্র বলছে, দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কারাগারে আবার কেউ বিদেশে আত্মগোপনে। কিন্তু এখনও বহাল তাদের ‘সাম্রাজ্য’। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ভাড়ায় খুন, সবই করছে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীরা। সম্প্রতি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। ঈদকে সামনে রেখে আতঙ্কে আছেন অনেক ব্যবসায়ী। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্ত আইনি ব্যবস্থায় এর থেকে নাগরিকদের মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। দ্রুতই এসব চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় আনা উচিৎ। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীলরা পরামর্শ দিয়েছেন-সন্ত্রাসীদের ভয়ে নীরবে চাঁদা না দিয়ে থানায় অভিযোগ করতে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি ঠেকাতে করণীয় জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, যখন কোনো নাগরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহায়তা চাইবে তখন যদি চাঁদাবাজকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায় তাহলে এটি কমে যাবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে তথ্য আসে শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ নিরবে নিভৃতে চাঁদা দিয়েও যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী : ২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি করে। সেখানে নাম উঠে আসে কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, হারিস আহমেদ, খোরশেদ আলম রাসু, পিচ্চি হেলাল, আলাউদ্দিন, কামাল পাশা, নাঈম আহমেদ টিটন, লিয়াকত, আরমান, জাফর আহমেদ মানিক, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নান, শামীম ওরফে আগা শামীম, মশিউর রহমান ও আবদুল জব্বার মুন্না। এদের কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে আবার কেউ কারাগারে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর মৌচাক মালিবাগের এক সময়কার ত্রাস খোরশেদ আলম রাসু গত বছরের সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি পেলেও তাকে ফের গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। নতুন করে অস্ত্র মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে রাসুর নামে মৌচাক এলাকার আধিপত্য ধরে রেখেছে তার ভাই ও সহযোগীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার বাইরেও রয়েছে বেশ কয়েক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী যাদের নামে চলছে চাঁদাবাজি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী ওরফে কলিংস, মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকায় আরমানের সহযোগীরা, মিরপুর এলাকায় শাহাদত বাহিনীর লোকেরা, মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় জিসানের অনুসারীসহ রাজধানীজুড়ে চলছে চাঁদাবাজি। পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ওয়ানটেড পারসন হিসাবে ১৮ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগ সূত্র বলছে, দেশের বাইরে বা কারাগারে অবস্থানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবি করা হলেও এর সঙ্গে ওই সন্ত্রাসীদের কতটা সম্পৃক্ততা আছে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট অ্যানালাইসিস (বিশ্লেষণ) নেই বিভাগটির কাছে। হোয়াটসঅ্যাপসহ তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে কারা ফোন করছে সব ক্ষেত্রে তা বের করাও যাচ্ছে না। ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে কারা চাঁদা দাবি করছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। ‘কেউ ফোন করে নিজেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বলে পরিচয় দিলেই কি সে জিসান হয়ে যাবে, সেটা তো প্রমাণের বিষয় আছে’-মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। ধানমন্ডি থানায় করা এক ব্যবসায়ীর জিডি সূত্রে জানা গেছে, ধানমন্ডির ১২/এ নম্বর রোডে তার বাসা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ও ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালে দুটি পৃথক নম্বর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান পরিচয়ে ফোন করে ওই ব্যবসায়ীকে বলা হয়, ‘র‌্যাবের সাথে সংঘর্ষে আমার কয়েকজন আহত হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন। আপনি কত টাকা দেবেন বলেন।’ ওই ব্যবসায়ী টাকা দিতে না চাওয়ায় অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ, ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয় ওই সন্ত্রাসী। জিডির তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার এসআই আশ্রাফুল ইসলাম ১০ মার্চ বলেন, একই রকম ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় আরো কয়েকটি জিডি হয়েছে। কারা এর সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, যে দুটি ফোন নম্বর থেকে চঁদা চেয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে সে সিম দুটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে তোলা। দুটি নম্বরই বন্ধ রয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বাড্ডা থানায় এএসআই নুরুজ্জামানের করা মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে পশ্চিম মেরুল বাড্ডার শিরিন টাওয়ারের গলিতে ‘ফুড কোর্ট’ নামে একটি রেস্তোরাঁতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢোকে ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী। রেস্তোরাঁ মালিক রায়হানের দিকে পিস্তল তাক করে সন্ত্রাসীরা চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘তোকে বলেছি যে ভাই ফোন দিয়েছিল। ১০ লাখ টাকা চেয়েছে। তুই চাঁদা দিবি, না হলে গুলি কইরা খুলি উড়াইয়া দিমু।’ তারা রেস্তোরাঁটিতে ভাঙচুর করে স্থান ত্যাগ করে। সূত্র বলছে, এরা বাড্ডা এলাকার এক সময়কার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী ওরফে কলিংসের অনুসারী পরিচয় দেয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপনে আছে মেহেদী। বাড্ডা ও এর আশপাশের এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে মেহেদীর অনুসারী। ডিএমপির গুলশান বিভাগের বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজন কুমার সাহা বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদীর লোক পরিচয়ে যারা চাঁদা দাবি করছে সম্প্রতি তাদের ১৫ থেকে ২০ জনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।