সবার দৃষ্টি সর্বোচ্চ আদালতে


সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ফের আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, যত দিন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের রায় বাতিল না হবে, ততদিন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এদিকে কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য রয়েছে। বৃহস্পতিবার শুনানির কথা থাকলেও রিটকারীদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় শুনানি মুলতবি করেন আদালত। কোটা বাতিলের দাবির পক্ষের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের আন্দোলন যৌক্তিক। কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন সেটি সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকবে কিনা-সেটি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। এটি বিচারাধীন বিষয়। অন্যদিকে রিটকারী পক্ষ বলেছে, কোটা বহাল রাখাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের ফলে সরকারি প্রজ্ঞাপনটি বাতিল হয়ে গেছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করায় সেটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হবে সর্বোচ্চ আদালতে। এমন পরিস্থিতিতে কোটা বহালের পক্ষ-বিপক্ষ সবার দৃষ্টি সুপ্রিমকোর্টে। এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে মনে করেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। শনিবার তিনি বলেন, এর আগে ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে। সরকার বাধ্য হয়ে তাদের দাবি মেনে নেয়। পরবর্তী সময়ে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। সেই থেকে ছাত্ররা আবারও একই দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। আপিল বিভাগ দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তারা কি সিদ্ধান্ত নেবেন এটা সম্পূর্ণ তাদের এখতিয়ার। বিচারাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধারা তো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটার সুবিধা পাবেন, এটার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। তবে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কোটা রেখে সরকার এটাকে পুনঃনির্ধারণ করতে পারে। জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান শনিবার বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি রয়েছে। রিট আবেদনকারীর পক্ষে সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ (আজ নয়) বলে আদেশ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ের কপি এখনও প্রকাশিত হয়নি। আশা করছি এ সপ্তাহে প্রকাশিত হলে লিভ টু আপিল দায়ের করা যাবে হবে। আগামী সপ্তাহে শুনানির জন্য তালিকায় আসতে পারে। ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর কোনো বাধা থাকল না বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী। তিনি শনিবার বলেন, আমি এখন দেশের বাইরে আছি। সোমবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছিল। বৃহস্পতিবার সেটি আপিল বিভাগের তালিকায় ছিল। ওইদিন আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে বলেছেন, লিভ টু আপিল ফাইল করতে। তিনি আরও বলেন, এখনও হাইকোর্টের রায়ের কপি প্রকাশিত হয়নি, হলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল ফাইল করবে। এরপর শুনানি। এর আগে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৮ সালে কোটাব্যবস্থা রেখে শুধু ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা রহিত করা হয় অপমানজনকভাবে। এ কোটাপদ্ধতি বাতিল করার কারণে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে শুধু চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি বা তার নিচের পদে চাকরি লাভের সুযোগ পেত। এটি জাতির কাছেও লজ্জার। কারণ, সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ রায় অনুসারে ৩০ শতাংশ কোটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্পষ্টত উল্লেখ আছে। যদি ৩০ শতাংশ কোটার ক্ষেত্রে প্রার্থী না পাওয়া গেলে, সে ক্ষেত্রে শূন্য পদ মেধার ভিত্তিতে জেলা কোটা থেকে নেওয়া যাবে। এর আগে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করে। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়। এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, যত দিন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের রায় বাতিল না হবে, তত দিন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে শুনানিতে আন্দোলনের প্রসঙ্গটি আসে। শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এত আন্দোলন কিসের, রাস্তায় শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিমকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে এই আবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের পলিসি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এখানে আইনের প্রশ্ন জড়িত, যে কারণে আবেদন নিয়ে এসেছি। ওইদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আগে কোটা ছিল। ২০১৮ সালে কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করা হয়। এটা বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করা হয়েছে। শুনানির অপেক্ষায় আছে।