সমঝোতার পথ রুদ্ধ সংঘাতের শঙ্কা


আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। সংকট নিরসনে আলোচনায় উভয়পক্ষই না বলে দিয়েছে। নিজ নিজ অবস্থানে অনড় তারা। বিপরীত মেরুতে থাকা দল দুটির আপাতত একমেরুতে আসার সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা বলেন, রাজপথকে সংকট সমাধানে আলোচনার বিকল্প ভাবা হচ্ছে। এতে ফল ভালো হয় না। অথচ রাজনীতি সেদিকেই যাচ্ছে। বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের রোডম্যাপের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই নতুন কর্মসূচি নিয়ে ‘অলআউট’ মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিকে রাজপথে প্রতিহতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। রাজপথে দুদলের এমন মুখোমুখি অবস্থানে রাজনীতি ফের সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কাই তীব্র হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে উৎকণ্ঠা। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা, বড় দুটি দল তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে তারা এক টেবিলে বসবে। আলোচনায় বসলে একটা সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান। কিন্তু সংকট সমাধানে সেই আলোচনায় দুদলই ‘না’ বলে দিয়েছে। এর মানে রাজনৈতিক সংকটের গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। বড় দুই দলের এমন অনড় অবস্থানে বাড়বে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এতে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে দিতে পারে। দেশের কথা চিন্তা করে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধান করা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। সম্প্রতি প্রভাবশালী দেশগুলোর নানামুখী তৎপরতায় অনেকেই সংকট সমাধানে সংলাপের ব্যাপারে আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের পর চিত্র পালটাচ্ছে। সোমবার সম্প্রচারিত ভিডিও সাক্ষাৎকারে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনকারী বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কাদের সঙ্গে আলোচনা করব? একে তো সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারপর আবার আমার বাবা-মা, ভাইবোনদের খুনি। তারপরও দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য কিন্তু আমি অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তবে এখন আর তাদের (বিএনপি) সঙ্গে কথা বলার মতো কিছু নেই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কিন্তু বারবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি, ২০১৮-এর নির্বাচনেও। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেল, যখন লাশ এসেছে মানবিক কারণে আমি প্রাইম মিনিস্টার, তারপরও সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাব বলে আমি গেলাম। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দিল না। আমি তাও গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে দেখি, তাদের লোকজন ভেতরে। আমাকে ঢুকতে না দিয়ে অপমান করা হলো। এখন আপনারা বলেন, এরপর কার সঙ্গে ডায়ালগ করব আমি?’ অতীতে বিএনপির আন্দোলনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার পর ওইসব পরিবারের লোকজন যে অবস্থায় আছে তা যদি কেউ চোখে দেখে, তখন আর ওদের (বিএনপি) সঙ্গে বসতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় ওদের সঙ্গে বসলে ওই পোড়া মানুষগুলোর পোড়া গন্ধ পাই। প্রধানমন্ত্রী সংলাপ নাকচ করে দেওয়ায় মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এক ভাগ এগিয়ে বলছে, তারা আলোচনাই চায় না। সংলাপ নিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যের জবাবে মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপিও সংলাপ চায় না। তিনি বলেন, এবার ফয়সালা হবে রাজপথে। বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করতে চান না-যুক্তরাষ্ট্রের ভয়েস অব আমেরিকায় এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা তো তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইনি। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ তারা মিথ্যা কথা বলে এবং জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। সে কারণে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জনগণ এবার রাজপথে ফয়সালা করে নেবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, রাজনৈতিক সংকট কখনো রাজপথে সমাধান হওয়া উচিত নয়। আন্দোলনের মাধ্যমে হয়তো একটা সমাধান হতে পারে কিন্তু সেটা কখনো টেকসই হয় না। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, দফায় দফায় জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে মানুষ দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতি সংঘাতময় হলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে। তাতে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় বলে বেড়ান সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে রাজনীতি করেন। তাহলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হয়। সবার প্রত্যাশা ছিল শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে আলোচনায় বসবে। তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আলোচনাকে না বলে দিয়েছে। তাদের এমন ঘোষণায় সবাই হতাশ। তিনি বলেন, আলোচনাকে না বলা মানে সংকটের সমাধান এখন রাজপথ। কিন্তু রাজপথে তো শান্তিপূর্ণ সমাধান হয় না। ফের যদি জ্বালাও-পোড়াও ও সংঘাতের রাজনীতি শুরু হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে কঠিন মাশুল দিতে হবে। না বলে দেওয়ার পরও আমরা আশাবাদী। আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করে জনগণকে সংঘাত থেকে রেহাই দেবে তারা।