সরেনি বানের পানি, নদী ভাঙনে দিশেহারা মানুষ


নোয়াখালীতে ভয়াবহ বন্যার এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অধিকাংশ এলাকা থেকে এখনও সরেনি পানি। ডুবে আছে খোদ জেলা শহর মাইজদীর নিচু এলাকা। এমনকি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেও জমে আছে পানি। অন্যদিকে, বন্যায় কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর রেগুলেটর (স্লুইসগেট) ভেঙে যাওয়ায় তীব্র নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। একের পর এক বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। গতকাল সোমবার নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ১০ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি পানিবন্দি। কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুরের কৃষক আব্দুর রব বলেন, ঘরবাড়ি হারানোর ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, এই বুঝি সব ভেঙে নিয়ে গেল। নদীর বাঁক ধীরে ধীরে বেড়িবাঁধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জেগে ওঠা চর খনন করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হলে পানির স্রোত আর এদিকে থাকবে না। নোয়াখালীর উন্নয়ন কর্মী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, পুকুর এবং দিঘি ছিল এই অঞ্চলের প্রধান অভিযোজন কৌশল। সরকারি সব দিঘি প্রায় বেহাত হয়ে গেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সব জলমহালের ইজারা বাতিল এবং জেলা পরিষদ থেকে বরাদ্দকৃত সব খাল ও খালপাড়ের বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া কৃষি ও মৎস্য-ডেইরি খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ায় এককালের সমৃদ্ধ জনপদ এখন অনেকটা সর্বনাশের পথে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় ছুটে গেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গতকাল সকাল থেকে তিনি বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। পানি কেন সরছে না, কমানোর উপায় কী, নদীভাঙন রোধে করণীয় কী– এসব বিষয়ে গণশুনানি করে পরামর্শ নিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। দুপুরে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গণশুনানিতে আসা অনেক সাধারণ মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা জানান, নোয়াখালীর বহু এলাকায় গাছপালা পড়ে গেছে। কয়েক দশকে গড়ে তোলা রাস্তাঘাট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফসলি জমি স্থায়ী জলাশয়ে রূপ নিয়েছে। গবাদি পশুগুলো খুব সস্তায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। যারা খামার বাঁচাতে পেরেছেন, তারাও গরুর খাবারের জোগান দিতে গিয়ে সমস্যায় আছেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের সুযোগ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, এ জেলাজুড়ে একসময় প্রচুর খাল ছিল, যা ছিল পানি ধারণের প্রাচীন উপায়। খালগুলো দিয়ে সেই বৃষ্টির পানি নদী হয়ে সমুদ্রে চলে যেত। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে খালগুলো ভরাট করে বাড়িঘর-দোকানপাট তোলা হয়েছে। কোথাও কোথাও খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি হয়েছে। খালের দুই দিক আটকে বানানো হয়েছে মাছের খামার। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এভাবে একে একে তুলে ধরেন সমস্যা-অভিযোগ। সবার কথা শুনে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীভাঙন রোধে দ্রুত কার্যক্রম শুরু হবে। ধানি জমি সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং বন্যাদুর্গতদের দুর্দশা লাঘবে কাজ চলছে। সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও খামারিদের সহায়তার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভাঙন ও নোনাপানি ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের মতামত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে। আজ জনগণ যেসব পরামর্শ দিলেন, তা বিবেচনা করা হবে। এর আগে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেগুলেটর ও জনতার বাজারের ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সারাদেশে নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন দস্যুতায় পরিণত হয়েছে। বালুখেকোদের এ দস্যুতা এখনই রুখতে হবে। বালু উত্তোলনকারীদের নিবৃত করে সরকারিভাবে নদী ড্রেজিং করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। এখানে নোনাপানির আগ্রাসন ঠেকাতে মুছাপুরে রেগুলেটর লাগবে উল্লেখ করে পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, রেগুলেটর দিনে দিনে তৈরি করা সম্ভব নয়। এটার একটা প্রক্রিয়া আছে। আমরা যদি দ্রুত গতিতেও রেগুলেটর নির্মাণ করতে চাই, তাও দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ, নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমিন ফয়সালসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। নদী দখলদার উচ্ছেদে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, সারাদেশের নদনদী থেকে চিহ্নিত ৬৬ হাজার দখলদার মুক্ত করতে দুই মাসের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর ভাঙা বাঁধ পরিদর্শনে এসে এ কথা জানান। উপদেষ্টা বলেন, সব জেলা প্রশাসকের প্রতি অনুশাসন থাকবে যেন নদনদী ও খালবিল দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেন।