সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চায় জাতীয় পার্টি


টানা তিনবারের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চায়। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা প্রশ্নেও একটি সম্মানজনক সমাধান আশা করছে দলটি। জাতীয় পার্টি মনে করছে, বিএনপিসহ তাদের বলয়ে থাকা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা বিশ্বসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের দৃষ্টি থাকবে এবারের এই ভোটে। তাই নির্বাচন যাতে যে কোনো মূল্যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এর নিশ্চয়তা চায় জাতীয় পার্টি। দলটি মনে করে, ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হলে এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে চমক লাগানো ফল পাবে জাতীয় পার্টি। তাই তারা সাধারণ ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে। প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রথমবারের মতন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে তারা। ওই নির্বাচনে (নবম) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দল নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এরপর আরও দুটি (দশম ও একাদশ) সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। দুবারই তারা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাসহ ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এতে অংশ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনের পাশাপাশি তাদের দীর্ঘদিনের জোট ১৪ দলের শরিকদেরও কিছু আসনে অতীতের মতো এবারও ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের জোটের শরিকদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে ভোট করবেন। এর বাইরে বাকিরা যার যার দলের নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে থাকবেন। এর বাইরে আসন সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চলছে জাতীয় পার্টিরও। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বরাবরের মতো এবারের নির্বাচনেও তাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে অংশ নেবেন। এছাড়া কিছু আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেবে। পর্দার আড়ালে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা চললেও শেষ পর্যন্ত কোন কোন আসনে সমঝোতা হবে-তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা কারও সঙ্গে আসন সমঝোতা কিংবা আসন ভাগাভাগিতে নেই। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাও হয়নি। তবে এটা ঠিক আওয়ামী লীগের সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আগামীতেও এ ধরনের আলোচনা হতে পারে। তারা ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। নির্বাচন কমিশনও আমাদের আশ্বাস দিয়েছে যে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তাই আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথম থেকে বলে এসেছি, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। পরিবেশ সুষ্ঠু থাকলে, ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে, তারা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতো একটি নীরব বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ আমরা মনে করি এ দেশে আওয়ামী লীগের পক্ষের ভোটের চেয়ে বিপক্ষের ভোট অনেক বেশি। জাতীয় পার্টির নিজস্ব ভোট এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট এক হলে জাতীয় পার্টিই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। গত ৪ ডিসেম্বর ১৪ দলের শরিকরা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেননি তিনি। জোটের সমন্বয়ক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুসহ চার সিনিয়র নেতার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে শরিকরা একাধিকবার আমির হোসেন আমুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে শরিক দলের শীর্ষনেতাদের আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী থাকবে না-এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। যদিও ১৪ দলের শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা মনে করছেন, তারা নিজেদের শক্তির ওপর ভর করে এককভাবে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন না। এ কারণে তারা আসন ভাগাভাগির পাশাপাশি জয়ের নিশ্চয়তাও চাইছেন। শরিকরা আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সব প্রার্থীর প্রত্যাহার চায়, যদিও আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই অবস্থা জাতীয় পার্টিরও। দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের আশ্বাস দেন। কিন্তু আসন ছাড়ের বিষয়ে তিনি কোনো নিশ্চয়তা দেননি। এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা। এরপর গত বুধবার রাতে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে গুলশানের একটি বাসায় বৈঠক করেন। গত শনি ও রোববার রাতেও আবার বৈঠক হয় এই দুই পক্ষের মধ্যে। তবে এসব বৈঠকে আসন সমঝোতা নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের বৈঠকগুলো করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনীয়তায়। বৈঠকের স্থান ও সময় কাউকে জানানো হচ্ছে না। বৈঠকে কারা অংশ নিচ্ছেন এবং কী আলোচনা হচ্ছে, তা যাতে প্রকাশ না পায়, তাই এই গোপনীয়তা বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিকদের আলাদা আলাদা বৈঠক আরও কয়েক দফা হবে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন। এর আগেই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আসন সমঝোতা এবং আওয়ামী লীগ তাদের ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের কোন কোন আসনে ছাড় দেবে-এটা ফয়সালা হবে। সংশ্লিষ্টরা মন করছেন, দফায় দফায় শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু আসন ভাগাভাগি বা সমঝোতার বিষয়ে এখনই তারা কোনো চূড়ান্ত কথা দিচ্ছে না। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত এভাবে শরিক ও মিত্রদের অপেক্ষায় রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিকরা আসন সমঝোতার বিষয়ে নিশ্চয়তা চান দ্রুত। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কৌশল চূড়ান্ত করার বিষয়টি অনেকটাই আটকে আছে জাতীয় পার্টির ওপর। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন হলে এক ধরনের কৌশল নিতে হবে। আর জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে আরেক কৌশল নেবে আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সমঝোতা হয়েছে এটা বলতে পারছি না। কারণ আওয়ামী লীগ আমাদের পরে জানাবে বলেছে। সেটা কখন হবে আমরা জানি না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। আসন সমঝোতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও উৎসবমুখর নির্বাচন চাই, জাতীয় পার্টিও তাই চায়। তিনি আরও বলেন, যেসব জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জনপ্রিয়তা রয়েছে, জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। সেখানে আমরা আমাদের প্রার্থীদের সরিয়ে দিতে পারি। এই ধরনের একটা আলাপ-আলোচনা আছে। আশা করছি উভয় পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থ বজায় রেখে একটা অবস্থানে এসে ছাড় দেবে।