স্বতন্ত্রদের কি বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ আছে? আইন কী বলে


বাংলাদেশের বিএনপিবিহীন সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের থেকেই সংসদে বিরোধী দল কে হবে, এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই শতাধিক আসন পেলেও আগের সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। যেখানে স্বতন্ত্ররা মিলে পেয়েছেন ৬২ আসন। ফলে সংসদে বিরোধী দলের আসনে কে বসতে যাচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। তবে আসন সংখ্যা যাই হোক, বিগত দুটি সংসদের মতো দ্বাদশ সংসদে তাদেরকে বিরোধীদল করার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার বলেছেন, স্বতন্ত্রদের আসন যতই থাকুক, দল হিসেবে জাতীয় পার্টির আসন বেশি থাকায় তারাই হবেন বিরোধী দল। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসিকে বলেন, আমরা বিরোধী দলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছি, আসন কম হওয়ায় তাকিয়ে আছি স্পিকারের সিদ্ধান্তের ওপর। আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনেই চূড়ান্ত হবে বিষয়টি। তবে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ইঙ্গিত দেয়ার পর স্বতন্ত্রদের মোর্চা গঠন করে বিরোধী দল হওয়ার যে আলোচনা তৈরি হয়েছিলো তা গুরুত্ব হারিয়েছে। যদিও নতুন নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ মনে করেন সময় এখনো ফুরিয়ে যায় নি। আইনে কি বলা আছে সংসদে বিরোধী দল বা বিরোধী দলের নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কেবল সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘বিরোধী দলীয় নেতা’ উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতা কারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত্রে দল বা অধিসংঘের নেতা। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসিকে বলেন, কার্যবিধি অনুযায়ী বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া স্পিকারের ওপর নির্ভর করে। তিনি স্বীকৃতি দিলে বিরোধী দলীয় নেতা উপনেতা সংসদ থেকে এক ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবে। স্বীকৃতি না দিলে সুযোগ সুবিধা পাবে না। সুযোগ সুবিধা না পেলেও আমাদের ভূমিকা বিরোধী দল হিসেবেই থাকবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বিবিসিকে বলেন, বিরোধীদল হতে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ না। সংসদে বিরোধী দল থাকবে সরকারের সমানে সমান। তারা গঠনমূলক বিরোধিতা করবে। তার জন্য আসলে শক্তি সামর্থ্য বা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রয়োজন। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাসদ রবের বিরোধীদল নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণ টেনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ন্যায্যভাবে ১১ জনে বিরোধী দল হয় না, সেক্ষেত্রে অন্যান্যদের সমর্থন নিয়ে বিরোধী দল হতে পারে। জাতীয় পার্টির প্রস্তুতি ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিতর্কিত একটি নির্বাচনের মাধ্যম যখন সরকার গঠন করেছিলো আওয়ামী লীগ, তখন ৩৪ আসন নিয়ে বিরোধীদলে বসেছিলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরপর ২০১৮ সালে ২২টি আর এবার ঠিক তার অর্ধেক আসন নিয়ে নিয়ে বিরোধীদলে বসতে সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে দলটি। এই ১১ জনই নিয়েই কি হবে বিরোধী দল? জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা বিরোধী দল হওয়া হওয়ার জন্য আমাদের দলের সিদ্ধান্ত স্পিকারকে জানিয়েছি। এখন তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার কার্যালয়ে এ নিয়ে বৈঠকে বসে জাতীয় পার্টি। বৈঠকে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা, আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ভারতের লোকসভার বিধানে আছে বিরোধী দল হতে ৩০ শতাংশ আসন লাগে। আমাদের পার্লামেন্টে এমন কিছু উল্লেখ নাই। যেহেতু লেখা নাই, সেহেতু স্পিকার ১১ জন হলেও দিতে পারেন, ৪০ জন হলেও দিতে পারেন। তিনি বলেন, গত টার্মেও আমরা বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের দু একজন সদস্যের কথা বার্তায় দলের মধ্যেও আপত্তি ছিলো। আমরা অতীতে যেভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছি, ভবিষ্যতেও সেভাবে পালন করব। কার্যবিধি অনুযায়ী বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া স্পিকারের ওপর নির্ভর করে। তিনি স্বীকৃতি দিলে বিরোধীদলীয় নেতা উপনেতা সংসদ থেকে এক ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবে। স্বীকৃতি না দিলে সুযোগ সুবিধা পাবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, \'সরকারের নিজেদের জন্য জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধী দল প্রয়োজন। সুতারং, আসন যাই হোক, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে ছাড়বে না সরকার। স্বতন্ত্রদের কী কোন সুযোগ আছে? ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জিতেছে আওয়ামী লীগ। যার বিপরীতে জাতীয় পার্টির আসন মাত্র ১১টি। কিন্তু দলগত হিসাব বাদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছে ৬২টি আসনে। বিরোধী দল নিয়ে এমন এক সংকট তৈরি হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ঐ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতেই জিতেছিল। তখন বিরোধী দল ও স্বতন্ত্ররা পেয়েছিলো মাত্র সাতটি আসন পায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, যেহেতু বিরোধী দল গঠন নিয়ে সংবিধান কিংবা আইনে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই, সেহেতু বিরোধী দল নিয়ে স্বতন্ত্রদের কারো কারো মধ্যে এক ধরনের আগ্রহও রয়েছে। স্বতন্ত্র যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা অনেকে আওয়ামী লীগে আসতে চান, কেউ কেউ বিরোধী দলেও থাকতে চান। সংসদ নেতা শেখ হাসিনার কাকে আওয়ামী লীগে রাখবেন আর কাকে তিনি বিরোধী দল হিসেবে রাখবেন সেটা একান্ত তার বিষয়। সৈয়দ সায়েদুল হক হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়েছে। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। এই সংসদে স্বতন্ত্রদের মোর্চা গঠন করে বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা বা সুযোগ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে এ ধরনের কোন আলাপ আলোচনা এখনো হয় নি। তবে বিরোধী দল হতে আইনে কোন বাঁধা নাই। যদি আমরা চাই তাহলে মোর্চা করা যাবে। আমরা প্রথম অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর হয়তো সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবো দেশের মঙ্গলের জন্য কোনটা ভালো হবে। দ্বাদশ সংসদে নির্বাচিত ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের মধ্যে ৫৯ জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। যাদের মধ্যে দলীয় পদ পদবী রয়েছে ৫৭ জনের। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যারা সরকারি দলের পদ পদবীতে আছে, তারা কিভাবে বিরোধীদল হবে? স্বতন্ত্ররা বিরোধী দল হলে সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দ্বাদশ নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী দল ইস্যুতে নানা আলোচনা হলেও এতদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি। সোমবার আওয়ামী লীগের এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ নিয়ে দলের অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দলই হবে প্রধান বিরোধীদল। স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই আছেন। দল যদি বলেন, তাহলে জাতীয় পার্টি। আগামী ৩০ জানুয়ারি বসবে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। তার আগে বিরোধী দলের ইস্যু পুরোপুরি সমাধান হবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।