স্বল্প সময়ে ভারি বৃষ্টির প্রবণতা বেড়েছে


বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে ব্যাপকভাবে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন এসেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মৌসুমি বৃষ্টিপাতেও। এতে স্বল্প সময়ে ভারি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ‘হাই ইমপ্যাক্ট রেইনফল’ হিসাবে পরিচিত এই বৃষ্টিপাত র‌্যাপিড অনসেট বা দ্রুত সূচনা হওয়া অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হিসাবে বিবেচিত। এই ধরনের বৃষ্টিপাত অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে স্বল্প সময়ের বন্যা পরিস্থিতি। দেশে আগে এমনটা খুব একটা দেখা যেত না। ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের ডাটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক দশকের বেশি সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে ১০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টির রেকর্ড পাওয়া যায়। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই, চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরবেরও সাময়িক বন্যার অন্যতম কারণ এই ধরনের বৃষ্টি। স্বল্প সময়ে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস বিষয়ে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়াবিদরা চ্যালেঞ্জে রয়েছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, হাই ইমপ্যাক্ট রেইনফলের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের অনেক দেশেই এই বৃষ্টিপাতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেসব দেশের আবহাওয়াবিদরাও কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে তার বিষয়ে পূর্বাভাস দিতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে যে গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা হয় তার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সিলেট বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাত হবে এটা আমরা বলতে পারি। কিন্তু নিউমেরিক ভেল্যুতে অর্থাৎ সেই বৃষ্টিপাত ১০০, ২০০, ৩০০ না ৪০০ মিলিমিটার হবে সেটি বলা সম্ভব নয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্ককরণবিষয়ক আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা স্থান ও সময়নির্ভর পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়ার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে তারা বর্তমানে কোথায় কখন কী ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি হবে তার পূর্বাভাস দিতে পারেন। তবে ভারি বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হতে পারে সে বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়ার বিষয়ে এখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ ধরনের বৃষ্টিপাতের ফলে সাময়িকভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা এবং অকস্মাৎ বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নগরায়ণের কারণে বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ ভারি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও পানি দ্রুত সরে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দেশের নদীগুলোতে নাব্যের ঘাটতিও প্রকট। দেশে অকস্মাৎ বন্যার জন্য ভারি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি উজানের বৃষ্টিপাতও দায়ী। বাংলাদেশ ক্রমশ ঢালু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা উত্তরদিকে গেলে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেক্ষেত্রে সুরমা, কুশিয়ারা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বৃষ্টিপাত হলে সে পানি নদীতে বাহিত হয়ে কিংবা ভূভাগের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নেমে আসে। একইভাবে মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুনাচল, নাগাল্যান্ড এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হলে সুরমা, কুশিয়ারা বা ভূভাগ দিয়ে গড়িয়ে পাহাড়ি ঢল আকারে নেমে এসে অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। এতে ক্রমশ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দেশের নদীগুলোর নাব্য ও স্রোত ঠিক থাকলে এই পানি সাধারণ প্রবাহে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। কিন্তু নাব্য সমস্যা, নদী খনন না হওয়া, খাল দখল হওয়া ও খনন না করা, হাওড়, পুকুরের মতো প্রাকৃতিক জলাধারের গভীরতা হ্রাস পাওয়ার কারণে দ্রুত নগরায়ণের ফলে পানির স্বাভাবিক বেরিয়ে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভারি বৃষ্টিপাতজনিত যে বন্যা হয় তার অনেক কিছু আমলে নেওয়া হয় না। সাধারণত ভারি বৃষ্টিপাতের আগে ৩-৪ দিন ছোট ছোট বৃষ্টিপাত হয়। এর ফলে স্থানীয় জলাধারগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ ভারি বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি কেন আধার না পেয়ে আটকে যায়। আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। সে কারণে ভারি বৃষ্টিপাতের আগে কয়েকদিন ধরে হওয়া ছোট বৃষ্টিপাত গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। তারা জানান, এই আকস্মিক বন্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নদীর নাব্য বাড়ানো, নদী খনন, খাল খনন, বিজ্ঞানসম্মত নগরায়ণের পাশাপাশি পানি ধরে রাখার আধার খনন করতে হবে। এক্ষেত্রে পাহাড়ি ঢল এলে সিলেট অঞ্চলসহ বন্যাপ্রবণ এলাকার পতিত জমিতে জলাধার তৈরি করতে হবে। এটি করা গেলে পাহাড়ি ঢলের গতি কমে আসবে। পরে এই ধরে রাখা পানি সেচের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এর পাশাপশি পুকুর, হাওড়গুলোকে তার প্রাকৃতিক রূপে রাখতে হবে। দখল ও ভরাট করা যাবে না। আকস্মিক বন্যার পানি বের হওয়ার প্রাকৃতিক যে প্রবাহ সেটি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। দেশে সাইক্লোন শেল্টার হলেও বন্যার জন্য কোনো শেল্টার নেই। বন্যাপ্রবণ এলাকায় শেল্টার হাউজ তৈরি করতে হবে। উঁচু স্থানে গবাদিপশু নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।