হৃদয়বিদারক ঘটনা: এএসপি ছেলেকে পুলিশের ইউনিফর্মে দেখা হলো না বাবার


মো. মাহমুদুল হক ৪১ বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার জন্ম জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। বাবা মো. হায়দার আলী পেশায় আইনজীবী সহকারী। মা মনোয়ারা বেগম পেশায় গৃহিণী। ২০১০ সালে শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১২ সালে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। এএসপি হিসেবে নিয়োগের আগে বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মানিক রাইহান বাপ্পী। আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই— প্রশানকর্তা : আপনার শৈশব কোথায় এবং কেমন কেটেছে? মাহমুদুল: আমার জন্ম জামালপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের চরাঞ্চলে। বাবাকে ছোটবেলায় কৃষিকাজ করতে দেখেছি। পরে জামালপুর জজকোর্টে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে লাইসেন্স পান। উনার সামান্য আয়েই পরিবারের সবার চলত। আমরা দুভাই ও এক বোন। বলা যায়, শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যেই। গ্রামের স্কুল থেকেই আমার প্রাথমিক পড়া শুরু হয়। প্রশানকর্তা : পড়ালেখায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কিনা? মাহমুদুল: হাজারও কষ্ট করে হলেও পড়াশোনার জন্য কোনো অভাব বুঝতে দেয়নি বাবা-মা। আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে। আমি বলতে পারি— পরিবারের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব সবটুকু দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রশানকর্তা :বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে? মাহমুদুল: দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্ট পেলেও আমার আব্বার ইচ্ছায় শুধু রাজনীতি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমার আব্বুর ইচ্ছা ছিল— ভালো প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিতে যেন নেতৃত্ব দিই আমি। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ে ভর্তি হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ভর্তির পর পরই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি। হল ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বেও ছিলাম। কোভিডকালীন সবকিছু যখন স্তিমিত হয়ে গেল, তখন আব্বু বলল— সিভিল সার্ভিসে চেষ্টা কর। ওই সময় বিসিএসের জন্য পড়া শুরু করি। আগেই ৪১তম বিসিএসে আবেদন করা ছিল। পরে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা দিই। প্রশানকর্তা : বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছেন কীভাবে? মাহমুদুল: কোভিডকালীন বড় ভাই ও বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে লাইব্রেরির বারান্দায় পড়ে প্রস্তুতি শুরু করি। এর পর যত চাকরির সার্কুলার হতো, সবগুলোতে আবেদন করতাম। ৪১তম প্রিলিমিনারি পাস করার পর আরও কয়েকটি পরীক্ষায় অংশ নিই, সেগুলোতেও উত্তীর্ণ হয়েছি। পরে ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করি। প্রশানকর্তা : ৪১তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা কেমন হয়েছিল? মাহমুদুল: রিটেন পরীক্ষার সময় আমার জীবনে একটা ট্র্যাজেডি এসেছিল। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর আমাদের বিসিএস লিখিত ইংরেজি পরীক্ষা হয়েছিল। ভালো পরীক্ষা দিয়ে খুশি মনে আব্বু-আম্মুকে কল করেছিলাম। আম্মুকে পেলেও বাবা ফোন রিসিভ করতে পারেনি। তবে এ সুখবরটি আম্মুর মাধ্যমে জানতে পারে আব্বু। পরে বাসায় ফেরার পথে আব্বু বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। পরীক্ষার কারণে আমাকে জানানো হয়নি। পরে স্থানীয় বন্ধু ও আত্মীয়দের মাধ্যমে জানতে পারি। বাসায় ফোনে জানতে চাইলে আম্মু বলে, আব্বু বাইক থেকে পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত পেয়েছে। অথচ আব্বু ততঃক্ষণে দুই হাসপাতাল ঘুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এদিন রাত ৯টায় জানতে পারি আব্বুর অ্যাক্সিডেন্টে ব্রেইন হ্যামারেজ হয়েছে। বেশিক্ষণ বাঁচবেন না। প্রশানকর্তা : বাবা লাইফসাপোর্টে, পরীক্ষার সময় নিজেকে কীভাবে স্থির রেখেছিলেন? মাহমুদুল: রাত ৩টায় আব্বুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমি আব্বুর পাশে ছুটে যেতে চেয়েছিলাম। পর দিন পরীক্ষা থাকায় কেউ আমাকে হাসপাতালে যেতে দেয়নি। পর দিন পরীক্ষায় বসলাম অন্যদিকে বাবা হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। পরীক্ষা শেষে হাসপাতালে পৌছে জানতে পারি— আব্বুর অবস্থা এতটাই রিস্কি যে, অপারেশন করার কোনো সুযোগ নেই। আব্বুকে আইসিইউতে লাইফসাপোর্টে রেখে অনেক চেষ্টা করেছি অপারেশন করার জন্য। কিন্তু ডাক্তাররা রাজি হননি অপারেশন করতে। সারারাত হাসপাতালে থেকে পর দিন সকালেও বাংলা পরীক্ষা দিই। লাইফসাপোর্টের ঘুম থেকে চিরদিনের ঘুমে চলে গেল আব্বু। পরীক্ষা শেষ করে আব্বুর লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। বাসায় পৌঁছে বাবাকে কবরে দাফন করে আবার ঢাকায় চলে এলাম। পর দিন গণিত পরীক্ষায় বসলাম। প্রশানকর্তা : বাবাকে দাফন করায় মানসিকভাবে কেমন ছিলেন? মাহমুদুল: আসলে আব্বু দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিসিএসের প্রতি আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। কখনই আমি বই নিয়ে টেবিলে বসেছি বলে মনে পড়ে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর ও ভাইভার কোনো প্রস্তুতি নিইনি। ভেবেছিলাম ভাইভাতেও অংশগ্রহণ করব না। আব্বু যেহেতু নেই, তা হলে বিসিএস ক্যাডার হয়ে কি হবে? আব্বুকে কবরে রেখে আসার পর প্রস্তুতি ছাড়াই বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়েছি। এখনো আমার কানে বাজে, বাবা সবসময় বলতেন— আমার ছেলে বড় নেতা হবে, পুলিশের এএসপি হবে। উনি আমায় নেতার আসনে দেখে গেছেন, পুলিশের এএসপি হিসেবে দেখা হলো না বাবার। আমাকে খুব পীড়া দেয় যে, মৃত্যুশয্যায় রেখে আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষার জন্য শেষবারের মতো কথা বলার সুযোগ হয়নি বাবার সঙ্গে। প্রশানকর্তা : বিসিএস জার্নিতে কাকে সব থেকে বেশি পাশে পেয়েছেন? মাহমুদুল: সত্যি কথা বলতে— আমার চাকরির প্রস্তুতির অনুপ্রেরণাটা আমার বাবার থেকে পেয়েছিলাম। মানসিকভাবে সবসময় আমাকে শক্ত রাখতেন। হলের বড়ভাই ও বন্ধুরাও আমাকে উৎসাহিত করেছে। আর আব্বু মারা যাওয়ার পর আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। প্রশানকর্তা : বিসিএসের যারা স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কি পরামর্শ থাকবে? মাহমুদুল: পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা থাকলে যে কারও পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব। সবার জীবনে ট্র্যাজেডি, চড়াই-উতরাই থাকবে, তবে ধৈর্য নিয়ে এগোতে হবে। পাশাপাশি প্রতিকূল সময়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। প্রশানকর্তা : রাজনীতি করলে ক্যারিয়ারে কেমন বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন? মাহমুদুল: যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের উদ্দেশ্যে বলব— রাজনীতির পাশাপাশি পড়াশোনা নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতি হতে হবে। পড়াশোনার পর অবসর সময় পেলে রাজনীতিতে অবদান রাখতে হবে। কিন্তু কখনো পড়াশোনাকে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নয়। প্রশানকর্তা :বর্তমানে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আছেন, পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করবেন কিনা? মাহমুদুল: আমি পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করতে চাই। আমার বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন— আমি যেন পুলিশের ইউনিফর্ম পরে থাকি। বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমার বাবার পছন্দেই পুলিশ ক্যাডার চয়েস দিয়েছিলাম। প্রশানকর্তা : কর্মজীবনে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? মাহমুদুল: নিজের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পুলিশ বাহিনীতে নিজেকে সর্বোচ্চ স্থানে দেখতে চাই। প্রশানকর্তা : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ। মাহমুদুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।