১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৪ হাজার কোটি টাকা


ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে মূলধন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি ১৫ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি (৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি) টাকা। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ভিত্তির অনুপাত (সিএআর) ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। নানা ছাড় ও নিবিড় তদারকির পরও তাদের মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এ অবস্থা ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতা নির্দেশ করে। মূলত আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, গত জুন শেষে ১৫টি ব্যাংক ঘাটতিতে থাকলেও পুরো খাতে মূলধন উদ্বৃত্ত ১২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। যা গত মার্চ শেষে ছিল ১৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে উদ্বৃত্ত মূলধন কমেছে ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বছরের পর বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতের খেলাপি বৃদ্ধির কারণে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। কারণ ঋণ যত বেশি খারাপ হবে, ওই ব্যাংককে তত বেশি প্রভিশন রাখতে হয়। আর জুন শেষে অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তাই ব্যাংকগুলো মুনাফা থেকে প্রভিশনিং করতে হয়েছে। এতে করে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে ১৫টি ব্যাংকের মধ্যে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এ খাতে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ছিল ২ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে এক সময় ব্যাপক লুটপাট হয়েছিল। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ২৩০ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত আরও দুটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি যথাক্রমে ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির পর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। আর সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বেশি সুদে তহবিল নিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার কারণে ঘাটতিতে পড়েছে, ঋণে অনিয়মও হয়েছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৩১৪ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি, সিটিজেন্স ব্যাংকের ৯৭ কোটি এবং বেঙ্গল ব্যাংকের ৮৮ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে। অপর একটি বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিদেশি দুটি ব্যাংকও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এ খাতে হাবিব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৬ কোটি এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মূলধন ঘাটতি ৪২ কোটি টাকা।