মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে ছুঁইছুঁই
অনলাইন নিউজ ডেক্স
দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই করছে দেশের মূল্যস্ফীতি। এতে ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ফেব্রুয়ারিতে এক ধাপ বৃদ্ধির পর রোজার আগে আরও এক ধাপ বেড়েছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। সেই সঙ্গে বেড়েছে খাদ্যপণ্যেও। মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে, যা ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে সামান্য কমে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার উপস্থাপন করা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করবেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মতিয়ার রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি কত হয়েছে সেটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপনের আগে আমার বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে কেন বাড়ছে সেটি বলা যায়। এক্ষেত্রে আমরা যখন বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করি তখন রোজার মাস শুরুর সময়টা। এ সময় সাধারণত মানুষ ব্যাপক কেনাকাটা করে। বিশেষ করে ফুড আইটেমের বিক্রি বেড়ে যায়। এরই প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোজার আগে হওয়ার পরও তথ্য সংগ্রহের সময় বদলানো হয়নি। কেননা আমরা চেয়েছি বাজারের প্রকৃত চিত্রটা উঠে আসুক। মার্চের হিসাবে সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেড়েছে মজুরি হারের সূচকও। এক্ষেত্রে মার্চ মাসে মজুরি সূচকের শতকরা হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৮, যা ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ৭ দশমিক ১১। এক্ষেত্রে এক মাসের ব্যবধানে মজুরি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মূলস্ফীতির হার কমতে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস ধারাবাহিকভাবে কমেছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এসে হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করে মূল্যস্ফীতি। এবার মার্চেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে এর পেছনে নানা কারণ তুলে ধরেছেন অর্থনীতিবিদরা। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, প্রধানত তিনটি কারণে হঠাৎ করে বাড়ছে দেশের মূল্যস্ফীতি। এগুলো হলো-রমজান মাসের কারণে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে নিয়েছেন। বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সিন্ডিকেটের জন্য তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। এবার বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর আরও সুযোগ পান তারা। এটা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। এছাড়া সার্বিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি এখনো অনেক ক্ষেত্রে অনুকূল নয়। অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে। বিশেষ করে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি আছে। তাই সরবরাহে ঘাটতি মূল্যস্ফীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।
সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরের আগস্ট মাসে এক যুগের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। মাসভিত্তিক সার্বিক মূল্যস্ফীতির দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশে। যেটি ছিল তার আগের ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশে। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এরপর আর এত বেশি ওঠেনি এই হার। গত ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা ও পেট্রোলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। এটি ছিল একবারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির রেকর্ড। এর পরপরই সব ধরনের পরিবহণ ভাড়াও বাড়ানো হয়। এরই প্রভাব পড়ে দেশের অন্যান্য পণ্যের দামের ওপর। এরপর গত ২৯ আগস্ট দাম সমন্বয়ের নামে জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমায় সরকার। সব কিছু মিলিয়ে তখন মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি স্বাভাবিক বলেই মনে করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম কমে গেলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আবার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসায় আগামী মাসগুলোতেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জোগান ও চাহিদা উভয় ক্ষেত্রই দায়ী। অর্থাৎ গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সেই প্রভাব নিত্যপণ্যে পড়তে কিছুটা সময় লাগে। চট করে তো পড়বে না। ফলে এখন পণ্যমূল্য বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা এপ্রিলেও থাকতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত পণ্যমূল্য সমন্বয় করা হয়নি। যেমন জ্বালানি তেলের দাম আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলে জোগানের ওপর প্রভাব পড়ছে। এদিকে চাহিদা ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকার বাজেট ঘাটতি কমাতে পারেনি। বরং এই ঘাটতি আরও বেড়েছে। ঘাটতি পূরণের ক্ষেত্রে এর অর্থায়ন পদ্ধতিও ঠিক নেই। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাপক ধার নিচ্ছে। ফলে টাকা ছাপানোর মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অর্থ বাজারে প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি নতুন রিফাইন্যান্সিং স্কিমে সরকার প্রায় ৫০-৭০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। সস্তায় দেওয়া এই অর্থ বাজারে প্রভাব ফেলছে। যেটি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।