রাসায়নিক ‘গুদামবোমায়’ অনিরাপদ পুরান ঢাকা


ঢাকা মহানগরীর আদি অঞ্চল পুরান ঢাকা। এক সময়ের ছিমছাম সুপরিকল্পিত অঞ্চলটি এখন ফুটপাতহীন সংকীর্ণ সড়ক, ঘিঞ্জি পরিবেশ, জরাজীর্ণ ভবনে ঠাসা। দুদিক থেকে দুটি মাঝারি ধরনের গাড়ি এলেই বন্ধ হয়ে যায় অধিকাংশ সড়ক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এ এলাকার সরু গলির দুপাশ ধরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রাসায়নিক গোডাউন ও কারখানা। আবাসিক ভবনেও অবাধে চলছে রাসায়নিক ব্যবসা। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অরক্ষিত এসব গোডাউন যেন একেকটি টাইমবোমা। যা এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যে কোনো সময়ে ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। এতে মারাত্মক বিপদে পড়বে পুরান ঢাকার ৮টি থানা এলাকার অধিবাসীরা। কারণ এই অঞ্চলের ৭০ শতাংশ সড়ক এখনো অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী। সংকট নিরসনে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন সরাতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলেও তা অনেকাংশেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একে অন্যের দায় চাপিয়ে দায় সারছেন। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা শনাক্ত করে গোডাউন উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনকে সুপারিশ করেছে তারা। আর সিটি করপোরেশনের দাবি, তারা সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। তবে যেখানে প্রশস্ত সড়ক নেই সেখানে নতুন করে বহুতল ভবন হওয়ার সুযোগ নেই। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে হবে। আর রাজউক জানিয়েছে, সমস্যা সমাধানে হাজারীবাগ এলাকায় ‘আরবান রিজেনারেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে কাজ চলছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুরান ঢাকায় ছোট আগুন থেকে চুড়িহাট্টা ও নিমতলীর মতো বড় দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামের কারণে ছোট আগুন থেকে অল্প সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর সক্ষমতা থাকলেও অবকাঠামোগত বাস্তবতা ও রাসায়নিকের উপস্থিতির কারণে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মূল সড়ক ছাড়া অন্য রাস্তাগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের মাঝারি মানের গাড়িও চলতে পারে না। আর মূল সড়কের পরিমাণ মোট রাস্তার ৩০ শতাংশেরও কম। এছাড়া অগ্নিনির্বাপণে পানির পর্যাপ্ত উৎস নেই। এ অবস্থায় আগের সুপারিশ অনুযায়ী রাসায়নিক গুদামগুলো সরানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর মতো পুরান ঢাকাকে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করে ‘আরবান রিজেনারেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন জরুরি। এতে ঘিঞ্জি অবস্থা থেকে বের করে পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাহলে অগ্নিঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যাবে। পুরান ঢাকার ৮টি মেট্রোপলিটন থানা হলো-হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, ওয়ারী ও গেণ্ডারিয়া। রাজধানীর বঙ্গবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে এই অঞ্চলের ভঙ্গুর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা। রবি ও সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পুরান ঢাকার অধিকাংশ সড়কেই চলাচলের প্রধান পরিবহণ রিকশা। কোনো সড়কে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার বা অন্য গাড়ি ঢুকলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যান চলাচল। নাজিরাবাজার চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণ দিকের সড়কসহ অনেক রাস্তায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে এসব সড়কে যান চলাচল দীর্ঘসময়ের জন্য বন্ধ থাকছে। ফায়ার সার্ভিসের যান চলাচলের মতো অবস্থা না থাকায় ক্রমেই বাড়ছে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, পুরান ঢাকায় আমাদের নজরদারি রয়েছে। সেখানকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা শনাক্ত করেছি। গোডাউন উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনকে সুপারিশ করেছি। তারাই ভালো বলতে পারবে এ সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকার গুদাম সরাতে আমরা কাজ করছি। এছাড়া সড়ক প্রশস্ত করে কীভাবে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়িগুলো চলাচলের ব্যবস্থা করা যায় সেই চিন্তাও আমাদের রয়েছে। তবে প্রশস্ত সড়ক না থাকা জায়গাগুলোতে নতুন করে ভবন না হওয়ার বিষয়ে রাজউককে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর থেকে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করতে থাকেন। যে কোনো সময় ফের বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছিলেন তারা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর মাধ্যমে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। চুড়িহাট্টার মর্মান্তিক অগ্নিদুর্ঘটনার চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন ওয়াসি উদ্দিন মাহির। তার চাচাতো ভাই আশিক উদ্দিন সৈনিক চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। তিনি জানান, পুরান ঢাকার অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। চুড়িহাট্টায় যেই ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, ওই ভবনেই এখনো প্লাস্টিকের গোডাউন রয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, অবৈধভাবে ভবন নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রম চলমান। হাজারীবাগ এলাকায় ‘আরবান রিজেনারেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে কাজ চলছে। যেখানে ৮-১০টি প্লট মিলিয়ে একটি অ্যাপার্টমেন্ট হবে। প্রশস্ত সড়ক হবে। পুরান ঢাকার সবাইকে প্রাপ্য অনুযায়ী ভাগ দেওয়া হবে।