বিএনপির ভোটেই নির্ধারিত হবে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী


ভোটের হিসাবে গোল বেধেছে বরিশাল সিটি নির্বাচনে। ১২ জুন এখানে মূল লড়াইটা যে নৌকার সঙ্গে হবে তা নিশ্চিত হলেও কে লড়বে সেই লড়াইয়ে সেটাই প্রশ্ন। নৌকার বিরুদ্ধে তিন প্রার্থী যুদ্ধে থাকলেও খোকন সেরনিয়াবাতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন কে সেই হিসাব এখন পর্যন্ত মেলাতে পারছে না কেউ। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, এখানে বিএনপির ভোটাররাই ঠিক করবে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষ কোনো প্রার্থীর প্রশ্নে এই দলের অধিকাংশ ভোটার এক হলে সেক্ষেত্রে হেরেও যেতে পারে নৌকা। যদিও এখন পর্যন্ত সেই সম্ভাবনা কম। কেননা হয়তো শেষ পর্যন্ত ৪ ভাগে ভাগ হবে বিএনপির ভোট। তেমন হলে ভোটার বিভক্তির এই সুযোগে জিতে যাবে নৌকা। অন্য সব নির্বাচনি এলাকার চেয়ে ব্যতিক্রম বরিশালের ভোটের হিসাব। এখানে প্রায় কখনোই ধানের শীষকে হারাতে পারেনি নৌকা। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ নির্বাচনগুলোর ফলাফল অনুযায়ী সব সময়ই এখানে বিপুল ভোটে জিতেছে বিএনপি। গৃহীত ভোটের শতকরা ৬০ ভাগের মালিক এই দলটি ৯০-পরবর্তী সময়ে মাত্র একবারই হেরেছে বরিশালে। সেটা ২০০৮ সালের সিটি নির্বাচনে। সেবার প্রায় ৪১ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন শওকত হোসেন হিরন। ৫৮৮ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সরফুদ্দিন সান্টু। ৫৮৮ ভোটের ব্যবধানে হিরন জিতলেও সেবার বিএনপির ৩ প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট ছিল ৯৪ হাজার। আওয়ামী লীগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ভোট পেলেও ৩ ভাগে বিভক্ত হওয়ায় জিতে যান হিরন। নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে ওই একবারই এখানে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ভোটের হিসাবের এমন বাস্তবতায় এবার কে হবেন নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেটা নিয়েই আলোচনা নগরজুড়ে। মুখে না বললেও দলীয় ভোটব্যাংকের পাশাপাশি বিএনপির ভোট পাওয়ার আশায় আছেন ২ মেয়র প্রার্থী। তারা হলেন লাঙ্গলের ইকবাল হোসেন তাপস এবং হাতপাখার মুফতি ফয়জুল করিম। এছাড়া বিএনপির ভোট পাবেন আশাতেই মাঠে নেমেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন। বিএনপি নেতা সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে রুপনকে ধানের শীষের ‘ছায়া প্রার্থী’ ভাবা হয়েছিল শুরুর দিকে। দলের প্রাথমিক সদস্যপদ না থাকায় রুপনের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না বিএনপি, তেমনি তাকে দিয়ে ভোটের মাঠ যাচাই করবে তারা-এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি থেকে রুপনকেও আজীবন বহিষ্কার করা হয়। এ সংক্রান্ত নোটিশে তাকে ‘বেইমান-মীরজাফর’ বলে আখ্যা দেয় দলটি। তারপরও ভোটের মাঠেই আছেন রুপন। পিতা সাবেক মেয়র কামাল এবং বিএনপি পরিবারের সন্তান হিসাবে ভোট চাইছেন সবার কাছে। বিএনপির একটি অংশ যে রুপনকে ভোট দেবে সেটা নিশ্চিত। তবে সেই ভোট নিয়ে কতদূর যেতে পারবেন তিনি তা বলা মুশকিল। দলীয় ভোটব্যাংক প্রশ্নে খুব একটা ভালো অবস্থানে না থাকলেও ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই আছেন হাতপাখার প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম। ২০০৮-র জাতীয় নির্বাচনে নেমে সদর আসনে ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ের ভোট বিশ্লেষণ অনুযায়ী সদর আসনে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ভোটের মালিক হতে পারে এই দলটি। নগর আলাদা করলে এই ভোটের সংখ্যা দাঁড়াবে ২০-২৫ হাজার। সেই হিসাবে বরিশাল নগরে ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো নিজস্ব ভোট রয়েছে দলটির। জিততে হলে আরও ৩৫ হাজার ভোট পেতে হবে ফয়জুল করিমকে। সাম্প্রতিক সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, বিএনপির ভোট পাওয়ার আশা নিয়েই নির্বাচনে নেমেছেন কিনা। সরাসরি কিছু না বলে তখন তিনি বলেন, ‘বিএনপির ভোট কেন বলছেন? বলুন যে এন্টি ইন্ডিয়া আর এন্টি আওয়ামী লীগের ভোট। যেহেতু নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নেই তাই এন্টি ইন্ডিয়া আর এন্টি আওয়ামী লীগের ভোট অবশ্যই আমি পাব।’ বিভিন্ন সময়ের হিসাবে বরিশালে জাতীয় পার্টির নিজস্ব ভোট রয়েছে ১০ হাজারের কিছু বেশি। ৫ বছর ধরে নির্বাচনি মাঠে থাকা লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের ব্যক্তি ইমেজ এবং তার প্রতিষ্ঠিত ‘ফর এভার লিভিং সোসাইটি’র মাধ্যমে যেসব সামাজিক কার্যক্রম চালানো হয়েছে তাতে এর সঙ্গে আরও ১৫ হাজার ভোট যোগ করা যায় খুব সহজেই। সেই হিসাবে জয়ী হওয়ার প্রশ্নে বিএনপির অন্তত ২৫ হাজার ভোট পড়তে হবে তার বাক্সে। এখানে যে ক’জন প্রার্থী আছেন তার মধ্যে শুরু থেকেই সরাসরি সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দিচ্ছেন তাপস। বিদ্যুৎ সংকট আর নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়েও কথা বলছেন তিনি। তাছাড়া প্রার্থীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত। এসব বিবেচনায় বিএনপির ভোট কতটা আসবে তার বাক্সে জানতে চাইলে ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকার প্রতি মানুষের কতটুকু ভালোবাসা আছে সেটা আমার চেয়ে আপনারা ভালো জানেন। বাকি রইল হাতপাখা। বরিশাল সদরের চরমোনাই ইউনিয়নে ২১ বছর ধরে তারা চেয়ারম্যান। খোঁজ নিয়ে দেখুন এই ২১ বছরে চরমোনাইয়ের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরিশালের মানুষ খুব কাছ থেকে দেখে তাদের। চরমোনাইয়ের আদ্যোপান্ত জানে তারা। অতএব হাতপাখার বাক্সে ভোট পড়বে কিনা সেটা ১২ তারিখেই দেখতে পারবেন। এরপর তো লাঙ্গল ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছি না।’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রশ্নে প্রার্থীরা এভাবে বললেও ভিন্ন আরেকটি হিসাব দিয়েছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের নির্বাহী পরিচালক হাসান রেজা। তিনি বলেন, ‘সব হিসাবই তো বললেন, কিন্তু জামায়াতের কথা তো বললেন না। বরিশাল নগরে কম করে হলেও ৮-১০ হাজার ভোট রয়েছে জামায়াতের। চিরশত্রু চরমোনাইকে যেমন তারা ভোট দেবে না, তেমনি তাদের ভোট নৌকায় যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। বিএনপির ভোটের অংশের সঙ্গে জামায়াতের ভোট জুটবে যার ভাগ্যে তিনিই আসলে হবেন নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। অবশ্য এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে বলা সম্ভব নয় যে, জামায়াত কাকে সমর্থন দেবে।’ এ ব্যাপারে আলাপকালে জামায়াতের বরিশাল মহানগর আমির জহিরউদ্দিন মু. বাবর বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে সব রকম নির্বাচন বর্জন করেছে জামায়াত। তাই এই নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের নেতাকর্মীদের কোনোরকম নির্দেশনাও দেইনি।’ বাবর এভাবে বললেও বাস্তবতা হচ্ছে বরিশালে ৪টি ওয়ার্ডে রয়েছে জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী। তাদের ভোট দেওয়ার জন্য হলেও কেন্দ্রে যাবেন দলটির ভোটাররা। তাছাড়া বিএনপি-জামায়াতের ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া নিশ্চিত করবে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ভোট দিতে গেলে কাউন্সিলরের পাশাপাশি মেয়র পদেও ঠিকই ভোট দেবে তারা। এসব মিলিয়ে এটা নিশ্চিত যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের ভোটেই নির্ধারিত হবে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।