জরায়ু কাটা হয় অদক্ষ হাতে
অনলাইন নিউজ ডেক্স
চিকিৎসা অবহেলায় নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রভাবশালী চিকিৎসক সংযুক্তা সাহাকে দায়ী করেছেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার দুই চিকিৎসক। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারা বলেন, ‘সবকিছুই হয়েছে সংযুক্তা সাহারা নির্দেশে। এ ঘটনায় আমাদের দায় কম। এছাড়া জরায়ু কাটা হয় অদক্ষ হাতে। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়।’ এদিকে ঘটনার দায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ওপর চাপিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহা। তার দাবি-রোগী ভর্তির সময় তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন। তাকে না জানিয়ে ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়। তাই নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর দায় তার না।
জবানবন্দি : ১৫ জুন মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দার আদালতে চিকিৎসক মুনা সাহা ও শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দিতে ডা. মুনা বলেন, ‘৯ জুন রাত ১০টা ২০ মিনিটে আমি ডিউটি শুরু করি। হাসপাতালে এসে ডাক্তার শাহজাদীকে বসে থাকতে দেখি। তাকে জিজ্ঞেস করি, কারও জন্য অপেক্ষা করছেন কিনা? ডা. শাহজাদী জানান, কুমিল্লা থেকে ডা. সংযুক্তার রোগী আসার কথা রয়েছে। তাই বসে আছেন। কিছু সময় পর তিনি (শাহজাদী) হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান এবং বলেন রোগী এলে যেন তাকে জানানো হয়। রাত ১২টা ২৫ মিনিটে রোগী মাহবুবা রহমান আঁখি অনেক ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তিনি জানান, কুমিল্লা থেকে আসার আগে ম্যাডামের (ডা. সংযুক্তা সাহা) সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। ফলে সংযুক্তা সাহা উপস্থিত না থাকার পরও তার নামেই রোগী ভর্তি করা হয়।’
ডা. মুনা বলেন, ‘আমাদের নিয়ম হলো যখন ম্যাডাম বিদেশে থাকেন তখনও রোগী উনার নামেই ভর্তি হবে। রোগীর প্রসব বেদনা ছিল এবং জরায়ু মুখ ৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত খোলা ছিল। বাচ্চার হার্টবিট চেক করার সময় ডা. শাহজাদী হাসপাতালে আসেন। রোগীকে হাঁটতে বলা হলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে দেখান। এরপর রোগীকে স্যালাইন দেওয়া হয়। কিন্তু এতে বাচ্চার হার্টবিট কম-বেশি হতে শুরু করে। ফলে স্যালাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরীকে ফোন করা হয়। কারণ সংযুক্তা সাহা না থাকলে তিনি এবং ডা. মাকসুদা ফরিদা আক্তার মিলি রোগী দেখেন। কিন্তু ডা. সামিনা চৌধুরী ফোন ধরেননি। অপরজনকে ফোন দেওয়ার আগেই বাচ্চার মাথা নিচে চলে আসে। তাই ডাক্তার শাহজাদী জরায়ুর সাইড কেটে দেন। কিন্তু এ কাজে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই। সাইড কাটতে গিয়ে তিনি ভুল করেছেন কিনা বলতে পারব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরপর প্রসবের জন্য চাপ দিতে বললে রোগী জানান তার ভালো লাগছে না। তখন তাকে অপারেশন টেবিলে নেওয়া হয়। ডা. রোকেয়া ও ডা. শাহজাদী রোগীকে নিয়ে যান। কিন্তু অপারেশন কক্ষের সামনে অভিভাবকদের কাউকে দেখা যায়নি। ওটি রুমে ঢুকে দেখি মনিটরে রোগীর পালস উঠছে না। তখন ডা. এহসানুর রহমান ও শাখাওয়াত আলম রোগীকে সিপিআর দিতে থাকেন। ডা. এহসানুর রহমান আইসিইউ ডাক্তারকে খবর দিতে বলেন। একপর্যায়ে দেখি ডাক্তার শাহজাদী বাচ্চা বের করছেন এবং ডা. রোকেয়া তাকে সহায়তা করছেন। বের করার পর বাচ্চা জীবিত ছিল কিন্তু কান্না করছিল না। তাই তাকে এনআইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওটিতে তখন মিলি ম্যাডাম রোগীর জরায়ুর সাইড কাটা অংশ সেলাই করছিলেন। আমরা তাকে সহায়তা করি।’
ডা. মুনা বলেন, ‘সংযুক্তা সাহার নাম বললেই তার অধীনে রোগী ভর্তি করতে হবে-এটাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সংযুক্তা সাহার নির্দেশ। এর ব্যতিক্রম হলে সংযুক্তা সাহা রাগ করেন। ৪-৫ মাস আগে সংযুক্ত সাহা বিদেশে থাকায় জুয়েনা নামে একজন রোগীকে ডা. ফারহানা আহমেদ ন্যান্সির আন্ডারে ভর্তি করা হয়। এতে সংযুক্তা সাহা রাগারাগি করেন। পরে ভর্তি বাতিল করে সংযুক্তা সাহার নামেই ভর্তি করতে হয়। কিন্তু অপারেশন করেন অধ্যাপক সামিনা। ওই বাচ্চা ও রোগীর সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু বিল কমিয়ে আপস করা হয়। পরে ডা. সংযুক্তা দেশে ফিরে ডিউটি ডাক্তারকে গালাগাল করেন। এমনকি ডাক্তার মালিয়াতকে লিখিত দিতে হয়েছিল যে সে ইচ্ছা করে অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠায়নি। সেন্ট্রাল হাসপাতালে অনেক গাইনি ডাক্তার আছেন। কিন্তু সংযুক্তা সাহার কারণে অন্য ডাক্তারের কাছে রোগী নেওয়া যায় না।’
অপর ডাক্তার শাহজাদী সুলতানা জবানবন্দিতে বলেন, ‘রাত ১১টায় ম্যাডাম (সংযুক্তা সাহা) আমাকে ফোন করে কুমিল্লার রোগী এসেছে কিনা জানতে চান। আমি না সূচক উত্তর দিই। ম্যাডাম আমাকে জানান, তিনি সোমবার আসবেন। রোগী এলে যেন আমি দেখি। এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন। রাত সাড়ে ১২টায় ডাক্তার মুনা ফোন করে কুমিল্লা থেকে রোগী আসার কথা জানান। রাত ১টায় আমি হাসপাতালে উপস্থিত হই। রোগীর স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা হয়। আমি রোগীকে দুটি ইনজেকশন দিই। কিন্তু বাচ্চার হার্টবিট আপ-ডাউন দেখে আমি অধ্যাপক সামিনা ম্যাডামকে তিনবার ফোন দিই। কিন্তু তিনি একবারও ফোন ধরেননি। এ সময় সংযুক্তা ম্যাডামের নির্দেশ মোতাবেক এরকম ক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো রোগীর সাইড কেটে দেই; যাতে ডেলিভারি সহজ হয়। এক দশমিক পাঁচ ইঞ্চি সাইড কাটা হয়। এরপর রোগীকে সন্তান প্রসবের জন্য চাপ দিতে বলা হয়। কিন্তু রোগী বলেন, তিনি আর পারছেন না এবং তার খারাপ লাগছে। রোগীকে দ্রুত অপারেশন টেবিলে নেওয়া হয়। ডাক্তার জামিল ও ডাক্তার আলম দুজনে সিপিআর দিতে থাকেন। কিন্তু তখনও ডা. মিলি এসে পৌঁছাননি। ডাক্তার জামিল ও আলম আমাকে বাচ্চা বের করে দিতে বলেন। এরপর জরায়ু সেলাই করা হয়। এ সময় জরায়ু নরম ছিল এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ অবস্থায় রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরদিন জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কারণ সেন্ট্রাল হাসপাতালে সিসিইউ সাপোর্ট নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সংযুক্তা ম্যাডামের নির্দেশমতো কাজ করেছি। ম্যাডামের কারণে অনেক হয়রানি হয়েছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক কিছুই জানে। কিন্তু কিছুই করে না। এখন আমাদের ওপর সবকিছু চালিয়ে দিচ্ছে।’
দায় আমার না, হাসপাতালের-ডা. সংযুক্তা : নবজাতকের মৃত্যুর পর মা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর দায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের বলে দাবি করেছেন সংযুক্তা সাহা। তিনি জানান, আঁখিকে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন তিনি দেশে ছিলেন না। তাকে না জানিয়ে ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। তাই শিশু ও মায়ের মৃত্যুর দায় তার না। আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে মঙ্গলবার রাজধানীর পরিবাগে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ডা. সংযুক্তা। সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখির অস্ত্রোপচারের ১০ দিন পর এ নিয়ে তার বক্তব্য জানা গেল।
ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘যে মানুষটা দেশে নাই তার নাম করে কেন রোগী ভর্তি করা হবে? এটা কার স্বার্থে? আমি যদি অপারেশন না করি, যদি নাই থাকি, তাহলে রোগী ভর্তি করাল কোন জ্ঞানে? এটা বেআইনি। এ ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী সেন্ট্রাল হাসপাতাল।’
এর আগে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক ডা. এটিএম নজরুল ইসলাম জানান, আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য সেন্ট্রাল হাসপাতালের অবহেলা ছিল। তবে তিনি প্রথমত সংযুক্তা সাহাকেই দায়ী করেছিলেন। কী গাফিলতি ছিল, সে প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘গাফিলতি ছিল প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার, তারপর ওটির চিকিৎসকদের। কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেননি।’
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংযুক্তা বলেন, ‘আমি সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছি। সে কারণে একটা পক্ষ আমার বিরুদ্ধে কাজ করছে। ওই মৃত্যু নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব, আপনারা এ অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।’
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২০০৭ সাল থেকে কনসালট্যান্ট হিসাবে কাজ করার কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘কোনো চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা এখানে নেই। বছরের পর বছর কোনো চিকিৎসকের লিখিত সম্মতি না নিয়ে রোগী ভর্তি করা হয়। মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করার সময়ও তার সম্মতি নেওয়া হয়নি। আঁখিকে ভর্তির সময় আমার উপস্থিতির ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে যে, আমি বাংলাদেশে আছি। হাসপাতালের এ ধরনের অপরাধমূলক পদক্ষেপ আমার সুনামকে ক্ষুণ্ন করেছে। এটা আর্থিক লাভের জন্য রোগীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসপাতাল তাদের অনিয়মের সাম্রাজ্য রক্ষায় আমাকে সহজ লক্ষ্যে পরিণত করেছে।’
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার আঁখি। সেজন্য গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা নিতে চান। প্রসব ব্যথা উঠলে ৯ জুন মধ্যরাতে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে যায় তার পরিবার। আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, প্রসূতিকে ভর্তির সময় চিকিৎসক সংযুক্তা হাসপাতালেই আছেন বলা হলেও আসলে তিনি ছিলেন না। সেই রাতেই ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়। সংকটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুরে তার মৃত্যু হয়।
আঁখি ও তার শিশু সন্তানের লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন : লাকসাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসা’য় মারা যাওয়া মাহবুবা আক্তার আঁখি ও তার শিশুর লাশ সোমবার রাত ১০টার দিকে লাকসাম উপজেলার লাকসাম পূর্ব ইউনিয়ন গাইনেরদরা ও তেলিপাড়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে ৯টার দিকে লাশ বাড়িতে পৌঁছলে আঁখির সহপাঠীসহ এলাকার শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করেন। এ সময় অনেকেই কন্নায় ভেঙে পড়েন। পরে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
আঁখি লাকসাম নরপাটি (লাকসাম পূর্ব) ইউনিয়নের গাইনের দরা গ্রামের প্রয়াত মাহবুবুর রহমানের মেয়ে। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের উচ্চতর গণিত বিষয়ের শেষবর্ষের ছাত্রী ছিলেন তিনি। তার স্বামী কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।