পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতি ‘যা পারেন লিখেন তথ্য দেব না’


‘আগে স্যারের (তত্ত্বাবধায়ক) বিরুদ্ধে লিখছেন, আমার বিরুদ্ধেও লিখবেন-এটা ধরেই নিচ্ছি। যা পারেন লিখেন, কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।’ এই হুমকি পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. দিলরুবা ইয়ামিন লিজার। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এখানে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রি হচ্ছে। এসব বিষয়ে তথ্য চাইলে তিনি বলেন, এগুলো যেনে কি করবেন? ডাক্তারের নাম-পরিচয় দিলে আপনি তাকে কল করে প্রশ্ন করবেন, কিন্তু এতে লাভ কি হবে? তাই তথ্য দেওয়া যাবে না। পরে এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সেবিকা পূজা বিশ্বাসকে কল করলে তিনি তত্ত্বাবধায়কের অনুমতি ব্যতীত কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। বিষয়টি বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডলকে অবহিত করলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে। তবুও স্বাস্থ্য খাতে এরকম বিশৃঙ্খলা এবং সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন। খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখব।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, র্দীঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ নিয়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক, হিসাব রক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুদক ও আদালতে মামলাও হয়েছে। কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে নারী গঠিত অভিযোগের তদন্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু ব্যবস্থার নামে শুধু বদলিতে ক্ষান্ত রয়েছে কর্তৃপক্ষ। লবিং তদবিরে বহাল তবিয়তে আছেন ওইসব ব্যক্তি। এসব বিষয় তুলে ধরে ৫ মার্চ তিবেদন প্রকাশ হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, টেন্ডার দুর্নীতির মাধ্যমে দেড়যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে এমএসআর খাতের ওষুধসহ যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করছে বরিশালের মেসার্স পিপলাই এন্টারপ্রাইজের মালিক মরন বাবু। তাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তত্ত্বাবধায়ক-হিসাবরক্ষক, স্টোরকিপারসহ আনুষঙ্গিক খাতে ১০ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে। টেন্ডার-পরবর্তী কার্যাদেশ এবং ভুয়া-বিল ভাউচারে ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে তত্ত্বাবধায়ক ৫ শতাংশ, হিসাবরক্ষক ৩ শতাংশ, স্টোরকিপারক ২ শতাংশ এবং আনুষঙ্গিক খাতে ২ শতাংশসহ মোট ১০ শতাংশ পারসেন্টিজ পেয়ে থাকেন। ৪র্থ ধাপে ভুয়া বিল-ভাউচারে অর্থ ছাড় করতে জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের অডিটর মোসা. ইরিনা বেগম ও জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পকেটে যায় ৫ শতাংশ পারসেন্টিজ। এসব খাতে অর্থ দিয়ে বরাদ্দের মাত্র ৫০ শতাংশ চিকিৎসা সামগ্রী হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ওষুধ নানা কৌশলে বাইরে বিক্রি হয়। এ ব্যাপারে অডিটর ইরিনার মতামত পাওয়া যায়নি। তবে জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোহাসিন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জানা যায়, রাতের আঁধারে কৌশলে ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী যে যার মতো পাচার করছে। কাগজ-কলমে বরাদ্দ সম্পাদন ও রোগীকে ওষুধ সরবরাহ দেখানো হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে জড়িত স্টোরকিপার শাহিনুর রহমান ও সেবীকারা। হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও সেবীকারা রোগীর স্বজনকে দামি ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে পাঠান। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবীকাদের দিলে তারা কৌশলে ক্রয়কৃত ওষুধ রেখে বরাদ্দের ওষুধ রোগীকে প্রয়োগ করেন। পরে সিন্ডিকেটের হাত ধরে ক্রয়কৃত ওষুধ যায় দোকানির কাছে। এভাবেই প্রতিনিয়ত ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী পাচারের মহোৎসব চলছে প্রতিষ্ঠানটিতে। শুধু তাই নয়, দূর থেকে আসা সিজারিয়ান রোগীদের ওষুধ কিনতে বাধ্য করেন সেবীকারা। তবে এই ওষুধ সুবিধা পাচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রোগীরা। ১১ জুলাই প্রতিষ্ঠান থেকে বেডসাইড লকার পাচারকালে স্থানীয়দের হাতে আটক হয় দুই যুবক। তাদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন প্রতিষ্ঠানটির ওর্য়াড সরদার জাফর চৌধুরী। পাচার হওয়া বেডসাইড লকার দুটি উদ্ধার হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়রা বলেন, র্দীঘদিন থেকেই স্বাস্থ্য সেবায় ব্যবহৃত ওষুধ, মেডিকেল সরঞ্জাম ও রোগীর খাবার সামগ্রী পাচার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির হিসাবরক্ষক হাসানুজ্জামান বলেন, মাদকাসাক্ত সুযোগ সন্ধানী একটি চক্র এসব করছে। স্টোরকিপারের জড়িত থাকার বিষয়টি জানি না। আর স্টোরকিপার শাহিনুর রহমান বলেন, ‘মাদকাসক্তরা এসব চুরি করছে। ওষুধ পাচারের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নাই।’ এসব বিষয় উপ-পরিচালক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজাকে অবহিত করে ওষুধ বরাদ্দের তথ্য চাওয়া হলে তিনি লিখিত আবেদন করতে বলেন। ৯ এপ্রিল তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে ৩০ এপ্রিল তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ডিজির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডিজি কোনো সারা দেননি। তাই তথ্য দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির লোকজন আমাকে সহায়তা করছে না, কীভাবে তথ্য দেব।’ এরপর সাফ জানান, কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না-যা পারেন লিখেন।