অশ্রুঝরা আগস্ট সূর্যসেন, প্রীতিলতার উত্তরসূরিদের প্রতিবাদ
অনলাইন নিউজ ডেক্স
পেছনে তাকানো ভালো কি মন্দ জানি না। তবে আমার সব সত্তা বারবার ফিরে যায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই দিনগুলোতে। কারণ সেই সময়ের যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ছাপ সেখানে মুদ্রিত হয়ে আছে তা বিস্মৃত হওয়া কঠিন।
পাশাপাশি সেই ভয়াল অন্ধকারে ‘বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’ শোককে শক্তিতে পরিণত করার যে অভিযাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তা তুলে ধরার তীব্র তাগিদও অনুভব করি অন্তরে। তাই ২০২৩ সালের এই আগস্টে দাঁড়িয়ে পঁচাত্তর-পরবর্তী কয়েকটি আগস্টের কিছু স্মৃতি এখানে তুলে ধরতে চাই সবিনয়ে।
আমি তখন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের ভেতরে তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিছু একটা করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তরুণ ছাত্রনেতা খোরশেদ আলম সুজন কাঠের ব্লকে ১/৮ সাইজের নিউজপ্রিন্ট কাগজে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত একটি লিফলেট প্রকাশ করেছিলেন। সেটি আমরা বিলি করেছিলাম গোপনে।
তারপর ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে সেনা পরিবেষ্টিত শহিদ মিনারের বেদিমূলে দাঁড়িয়ে সুজন ভাইয়ের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। তারপর দ্রুত মিশে গিয়েছিলাম প্রভাতফেরির জনস্রোতে। কিন্তু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না।
এক পর্যায়ে আমরা একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তাহলো, যত বাধাই আসুক যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদতবার্ষিকী পালন করব। সে অনুযায়ী রাত ১২টা থেকে কুরআনখানি শুরু হলো।
একই সঙ্গে চলতে লাগল কাঙালিভোজের আয়োজন। কেউ চাল দিল, কেউ ডাল। গরু কিনে দিয়েছিলেন স্থানীয় নিভৃতচারী এক ব্যাংক ম্যানেজার-যিনি বঙ্গবন্ধুর জন্য নীরবে অশ্রুপাত করতেন। খুব সন্তর্পণে সমমনা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো মিলাদ হবে। বঙ্গবন্ধুসহ সেই কালরাতের শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত হবে। হবে সংক্ষিপ্ত একটি স্মরণসভাও।
রাত একটার দিকে আসে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি। তারা জানতে চান, এখানে কী হচ্ছে? আমরা সত্য কথাই বলি। তারা আয়োজকদের নাম-ঠিকানা জানতে চান। আমি প্রথমেই আমার ও আমার বড় ভাই রাশেদ মনোয়ারের নাম বলি। পরে ওদের চাপের মুখে আরও কয়েকজনের নাম বলি।
এখন ভেবে শিহরিত হচ্ছি যে, আমরা দুভাই ছাড়া মূল উদ্যোক্তাদের ৫ জনই ছিল স্কুলের অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্র। সব তথ্য জানার পর যথারীতি পুলিশ তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। যতদূর মনে আছে, সেদিন তারা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিলেন।
রান্না শেষ। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা যখন মিলাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকার। কী হচ্ছে বুঝতে না পারলেও আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকি। যা হওয়ার হবে! ঠিক তখনই আর্মির গাড়িটি এসে থামে আমাদের সামনে। পেছনে আরও দুটি। উত্তেজিত ভঙ্গিতে একজন অফিসার নেমে আসেন গাড়ি থেকে। কিছুটা অবাকও হন আমাদের অনড় অবস্থান দেখে। পুলিশের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা এসে তাকে স্যালুট করেন। কিছুটা রাগত স্বরে তিনি জানতে চান, এখানে কী হচ্ছে? পুলিশ কর্মকর্তা আমতা আমতা করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। সামরিক কর্তা চিৎকার করে জানতে চান, এখানে নেতা কে? আমরা দুই ভাই এগিয়ে যাই। বলি, ‘আমরা’। পেছনে তাকিয়ে দেখি স্কুলপড়ুয়া সেই বালকের দল আমাদের ছেড়ে যায়নি। আর্মি অফিসারও চোখ কুঁচকে তাদের দেখেন। তারপর ওয়াকিটকিতে কার সঙ্গে যেন ‘স্যার স্যার’ করে কথা বলেন কয়েক মিনিট। বলেন, ‘ও কিছু না স্যার। কয়েকটা পিচ্চি। পুলিশকে বলে দিচ্ছি। ওরাই সব সামাল দেবে।’
সেদিন আমরা মিলাদ করতে পারিনি। হয়নি কাঙালিভোজও। রান্না করা খাবারগুলো হাঁড়িসুদ্ধ ছুড়ে ফেলা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী ডোবায়। আজ দীর্ঘ সাড়ে চার দশক পর সেই দিনটির কথা ভাবতে গিয়ে, সেই সব অকুতোভয় বালকের কথা মনে পড়ে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। লিটন (জামশেদুল হায়দার চৌধুরী) ও নাসিরের কথা আমি কীভাবে বিস্মৃত হব? সত্যি বলতে কী, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়েছিল তারাই। মনে পড়ে আমার স্কুলবন্ধু শাহরিয়ার খালেদের কথাও। সেও ছিল বুক চিতিয়ে। সূর্যসেন ও প্রীতিলতার উত্তরসূরিদের নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানাই। তারাই তো আমাদের সাহস জুগিয়েছিল সেদিন।
তারপরের ইতিহাস সবাই জানেন। সব ভয়কে জয় করে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদতবার্ষিকী স্মরণিকা’ হিসাবে আমরা প্রকাশ করি ‘এপিটাফ’; ১৯৭৯ সালে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ এবং ১৯৮০ সালে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষরসহ ‘আবার যুদ্ধে যাব’ শিরোনামে একটি দুঃসাহসী বিশেষ বুলেটিন। এগুলো এখন আমাদের প্রতিবাদী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় পাঁচ দশকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, শোককে শক্তিতে পরিণত করার সংকল্প নিয়ে সেদিন আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিবাদের যে বীজ বপন করেছিলাম তা আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। তাকে পরাস্ত করার শক্তি কারও নেই।
মিনার মনসুর : কবি, পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।