সাইবার হামলার শঙ্কায় সুরক্ষা ওয়েবসাইট বন্ধ


দেশব্যাপী তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সাইবার হামলার শঙ্কায় এবার করোনাভাইরাস টিকার নিবন্ধন সুরক্ষা ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে গেল। এর ফলে করোনাভাইরাসের টিকা নিবন্ধন ও সনদপ্রাপ্তিসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন শাখা (এমআইএস) থেকে করোনা টিকাসংক্রান্ত সমুদয় সেবা বন্ধ রয়েছে। ৫ থেকে এই ওয়েবসাইট ডাউন করে রাখলেও তা জানাজানি হয় সোমবার। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে তোলপাড় চলছে। কর্তৃপক্ষ আশা করছে ১৫ আগস্টের পর ওয়েবসাইটটি সচল হতে পারে। এদিকে টিকা নিবন্ধন ও সনদপ্রাপ্তির স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। রাজধানীর খিলক্ষেত নিকুঞ্জের বাসিন্দা আসিফ হোসেন জানান, তিনি ভারতে ভ্রমণের জন্য টিকার সনদ ডাউনলোড করে সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তিনি গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত সুরক্ষা সার্ভারে প্রবেশ করতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার মতো অনেক ভুক্তভোগী গত দু-তিন দিন ধরে এভাবে চেষ্টা করছেন। সবাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান পাননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিট (এমআইএস) প্রধান ডা. শাহ্ আলী আকবর আশরাফী সোমবার বলেন, সুরক্ষা ওয়েবসাইটে ডি-ডস (ওয়েবসাইট ডাউন করে তথ্য হ্যাকিং) অ্যাটাক হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আমরা (এমআইএস) জানাতে পারব না। তিনি বলেন, আইসিটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ভালো বলতে পারবে। আমরা শুধু বিজনেস প্রসেস ও নতুন নতুন প্রোগ্রাম সম্পর্কে তাদের জানিয়ে দিই। কিন্তু সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট ও নতুন নতুন ফিচার তৈরির বিষয়ে দেখভাল করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ। ওই দপ্তরের পরিচালক এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টিও বিসিসি দেখে। বিসিসি পরিচালকও এ বিষয়ে বলতে পারবেন। সুরক্ষা অ্যাপসটি টেস্টিংয়ের জন্য বিসিসি থেকে আপাতত লিংকটি ডাউন করে রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কেন ডাউন করা হয়েছে এ ব্যাপারে আইসিটি বিভাগ বলতে পারবে। তারা একটি মেইল করে আমাদের জানিয়েছে টেস্টিংয়ের জন্য। এমআইএস’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহাদত হোসেন বলেন, সুরক্ষা অ্যাপসে সাইবার অ্যাটাক হয়নি। তবে নিরাপত্তাঝুঁকি থাকায় আমরা সাইটিটির ভালনেরাবেলিটি টেস্ট করছি। যাতে কোনোভাবেই কেউ হ্যাক করতে না পারে। সেজন্য আইসিটি বিভাগের সহায়তায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ৫ আগস্ট থেকে সাইটটি ডাউন করে রাখা হয়েছে। পুরো সিস্টেমটা ট্র্যাক করার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। তিনি আরও জানান, আইসিটি বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে সার্ভার বন্ধের বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছে। আমরা তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকের তথ্য বেহাতের শঙ্কা রয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তথ্য হারানোর ভয় নেই, তবে অন্যের কাছে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকতে পারে। এ বিষয়ে বিসিসি নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার বলেন, শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা নয়, সারা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই সাইবার অ্যাটাকের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকেই চিঠি দিয়েছি। সুরক্ষা বা অন্য যে কোনো ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিআইএস) হোক নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার বিষয়টি তাদেরই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের হাতে ডাটা সেন্টার সম্পর্কিত যেই সাইটগুলো আছে সেগুলোতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সতর্কমূলক বার্তা পাঠিয়েছি। জনসাধারণের উদ্দেশে বলব, নিজেদের ওয়েবসাইট এবং অ্যাপসের নিরাপত্তা জোরদার করুন। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভির জোহা বলেন, ‘আমরা যে কোনো অ্যাপস বা ওয়েবসাইট সহজেই দ্রুত সময়ের মধ্যে তৈরি করে ফেলি। কিন্তু সেটির নিরাপত্তা নিশ্চিতে পরে আর পদক্ষেপ নিই না। এজন্য দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক সাইবার সিকিউরিটি বাজেট রাখা দরকার, তা রাখা হয় না। ফলে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি হ্যাকারদের ভয়ে সুরক্ষা ওয়েবসাইট বন্ধ রাখে তাহলে তো আর হ্যাকারদের হ্যাক করার দরকার নেই। ইতোমধ্যে হ্যাকারদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়। আমাদের ন্যাশনাল ডাটা সেন্টারের সুরক্ষার জন্য ফায়ারওয়াল জোরদারের ওপর নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে। আইটি খাতকে গুরুত্বও দেওয়া হচ্ছে। এরপরও এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। এজন্য দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। নাগরিকের তথ্য অন্যের হাতে চলে গেলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সুরক্ষা ওয়েবসাইটটি দেখভাল করা হয়। এই সাইট ব্যবহার করে করোনা টিকার জন্য আবেদন, টিকাপ্রাপ্তির সনদ, সনদের ভুল সংশোধন করা হয়। হজ, বিদেশ ভ্রমণ, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যোগদানের ক্ষেত্রে টিকা সনদের প্রয়োজন পড়ে। টিকা কার্ডে ব্যক্তির নাম, পিতা-মাতার নাম, বয়স, জন্মতারিখ, লিঙ্গ পরিচয়, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, নিজ জেলা-উপজেলা, টিকা কেন্দ্র উল্লেখ থাকে। ধারণা করা হচ্ছে ১৫ আগস্টের পরপর সাইটটি সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত করতে না পারলে ডাটা চুরির ভয়টি থেকেই যাবে।