তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল মানুষের জন্য


বাংলাভাষী বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিনগুলো হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর-এ তিনটি দিন বাঙালিকে চিরকাল পরম গৌরবে উদ্ভাসিত করবে। আর ১৫ই আগস্ট দিনটি স্মরণ করা হবে বাঙালি জাতির ইতিহাসের অনপনেয় কলঙ্কের দিন হিসাবে। এই দিনটিতে চরম দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, নিষ্ঠুর কিছু মানুষ, যারা পশুরও অধম, তারা তাদের রাজনৈতিক পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার জন্য কেবল জাতির পিতাকেই হত্যা করেনি; তার শিশুসন্তান এবং নবপরিণীতা পুত্রবধূদের হত্যা করতে দ্বিধা করেনি; তাদের বিবেক কম্পিত হয়নি। বিশ্ব জানে, বাঙালি জানে, উল্লিখিত মহৎ দিনগুলো সৃষ্টির মহানায়ক হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুই বাঙালির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন তার নিজের রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হয় সেই রাষ্ট্রের মালিক; অর্থাৎ, এই রাষ্ট্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস এবং তাদের মুখের ভাষা বাংলাই এই রাষ্ট্রের ভাষা। বঙ্গবন্ধুই সৃষ্টি করলেন ‘বাঙালির প্রথম রাষ্ট্র’। এর আগে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আমরা ‘তথাকথিত স্বাধীন বাংলা’ পেয়েছি, যেখানে রাজা এবং তার সহযোগী অমাত্যরাই ছিলেন স্বাধীন; সাধারণ বাঙালিরা নয়, তারা ছিল প্রজা; রাজার ভ্রুকুটিতে তাদের প্রাণসংশয়ও হতো। বাঙালিকে তার প্রথম নিজস্ব সংবিধানও বঙ্গবন্ধুই অর্পণ করেন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। এই সংবিধানের মূল ভাষ্যও বাংলায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাঙালি দুটি প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল : ১৯০ বছর ইংরেজের অধীনে, ২৩ বছর পাঞ্জাবি ও উর্দুভাষী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে। এ দুই ঔপনিবেশিক শাসন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশটিকে (বার্নিয়ার, টেভার্নিয়ার প্রমুখ পরিব্রাজকের বর্ণনা অনুযায়ী) পরিণত করেছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম রাষ্ট্রগুলোর একটিতে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছরই কাটিয়েছিলেন কারান্তরালে-বাঙালিকে পরাধীনতামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে ঋদ্ধ একটি অস্তিত্ব বা জীবন প্রদান করতে-যে জীবন হবে ক্ষুধামুক্ত; স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সংস্কৃতিঋদ্ধ। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায়-পাতায় এই ঐকান্তিক ইচ্ছা বা আকুলতা বারবার ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৫৩ সালেই লিখেছেন : ‘এদিকে পূর্ব বাংলার সম্পদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায় একদল পশ্চিমা তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড়ো বড়ো সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলেছিল।...আওয়ামী লীগ যখন হিসাব-নিকাশ বের করে প্রমাণ করল যে, পূর্ব বাংলাকে কী করে শোষণ করা হচ্ছে তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠল এবং আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর চরম অত্যাচার করতে আরম্ভ করল’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে প্রথম হরতাল আহ্বান করেন এর জন্য তাকে হরতালরত অবস্থায় গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় ৭০ জন সহকর্মীসহ। সেসময় তিনি কারাগারে ছিলেন পাঁচ দিন। ১৯৪৮ সালের প্রথমার্ধে এই পাঁচ দিনের কারাবাস দিয়ে তার যে কারাজীবনের শুরু হয় ‘বাঙালির অধিকার আদায়ের’ জন্য, তা ১৯৫৩ সালের মধ্যেই তিন বছরব্যাপী দীর্ঘ হয়েছিল। এই তিন বছরে বারবার তিনি কারাগারে গেছেন। এই তিন বছরের মধ্যে একটা সময় তিনি সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। বিশ্বমানবের মুক্তিকামী শ্রেষ্ঠ নেতাদের মতো, এই জেলজীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন তিনি নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে। যেহেতু তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কখনোই কোনো আপস বা নমনীয়তা দেখাননি, তাই পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র সব সময় তাকে পাকিস্তানের ‘শোষকদের বিরুদ্ধে ত্রাস’ হিসাবেই বিবেচনা করেছে; জেলের কুঠুরিতে রাখাই তাদের শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে নিরাপদ মনে করেছে। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তই নিয়োগ করেছিলেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে। বঙ্গবন্ধু কেবল বাংলাদেশ সৃষ্টির মহানায়কই ছিলেন না; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল অবকাঠামো নির্মাণ ও এর অগ্রগতির পথ-সৃষ্টিরও মহাশিল্পী ছিলেন। তার কাল থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আজ আমরা এই সত্যকে উপলব্ধি করি-যখন আমরা তার স্বাধীনতা-উত্তর প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কার‌্যাবলি বিশ্লেষণ করে দেখি। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেকের পক্ষে তখন এই সত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। এই সুযোগই গ্রহণ করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। সব কালেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। ১৯২০-এর দশকে লেনিন যখন সোভিয়েত-ইউনিয়নকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সময় অনেকেই তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। লেনিনকেও এই সুযোগ নিয়েই প্রতিক্রিয়াশীলরা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবিদ্ধ করেছিল। আরও অনেক মহাপ্রাণ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু, লেনিনের মতো এই ধরনের যুদ্ধাপরাধী-দেশদ্রোহীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন; যেমন : আব্রাহাম লিংকন। পাকিস্তানপন্থি যুদ্ধাপরাধী-দেশদ্রোহীরা ১৫ আগস্টে কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি; তারা হত্যা করেছিল এদেশের জনগণের ‘মুক্তির সংগ্রাম’কে, মুক্তির স্বপ্নকে। তাই পনেরোই আগস্টে তাকে হারানোর বেদনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের প্রেরণা এবং সাহসে শোককে যেন শক্তিতে রূপান্তরিত করে তার হত্যার বদলা নিতে পারি। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ