ভর্তি বাণিজ্যে বিপুল অর্থ আয় অধ্যক্ষের


নোয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সালমা আক্তার দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি বাণিজ্য করেছেন কোটি কোটি টাকা। এজন্য কলেজের কিছু শিক্ষক নিয়ে তৈরি করেছেন সিন্ডিকেট। অবৈধ সুবিধা নিয়ে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্ধারিত ছাত্রের বাইরে তিনি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছেন। বিপুল পরিমাণ ছাত্রের জন্য ক্লাসরুম না থাকায় সিন্ডিকেট সদস্যরা এলাকায় কোচিং বাণিজ্যের সুবিধা নিচ্ছেন। কলেজেরই এক শিক্ষক এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দেন। গুরুতর এ অভিযোগ সরেজমিন তদন্ত করে সত্যতা মিলেছে। এরপর এই অধ্যক্ষের আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ৮ জুন প্রতিবেদনটি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জমা হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শুধু অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তির বিষয় নয়, নকলকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ সালমা আক্তার। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, পড়ালেখা নেই প্রতিষ্ঠানটিতে। পাবলিক পরীক্ষায় নকলে বাধা দেওয়ায় ৭ শিক্ষক ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী কয়েকজনের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। স্থানীয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির কয়েক নেতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নকল উন্মুক্ত করে দেন। এমনকি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কেন্দ্রে ঢুকেন কয়েক ছাত্রলীগ নেতা। তারা একাধিক শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে তাদের নকলে বাধা না দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের হুমকি দেন। বিষয়টি অধ্যক্ষকে জানিয়েও কোনো ফল পাননি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা একাধিক শিক্ষক। নথিপত্রে দেখা যায়, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নকলে সহযোগিতাসহ দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা তথ্য তুলে ধরে শিক্ষা সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা সচিব গুরুতর এসব অভিযোগ তদন্তেরও নির্দেশ দেন। কিন্তু তা গোপন করে উলটো অভিযোগের তির যে সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে, তাকে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিসিএস শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে নকল উন্মুক্ত করার অভিযোগ তদন্তও করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়াও নকলে বাধা দিয়ে ছাত্রলীগের কথিত একাধিক নেতার দ্বারা নাজেহালের বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছেও লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এরপর নোয়াখালী পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলামের সঙ্গে ছাত্রলীগের কথিত নেতার তোলা একটি ছবি ভাইরাল হয়। শিক্ষক আব্দুর রজ্জাককে নাজেহাল করার পর ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ সালমা আক্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে দাপ্তরিক চিঠি দিয়েছিলেন গত বছরের ১৭ নভেম্বর। জানতে চাইলে এসপি শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে এরকম অভিযোগ এলে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দিই। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি না। ছবি কখন তোলা হয়েছে, আমি মনে করতে পারছি না। তবে এরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ সম্পর্কে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কলেজ থেকেও শিক্ষক রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। কলেজটিতে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং আছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টকে দেখতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নকলের বিষয়টি আমাদের কানে আসার পর ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া হয়েছিল।’ দুদকের তদন্তে যা আছে : জানা যায়, দুদকের কুমিল্লা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাসুম আলীর নেতৃত্বে ৫ জুন এনফোর্সমেন্ট টিম নোয়াখালী সরকারি কলেজে অভিযান চালায়। অভিযোগ পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধ্যক্ষ সালমা আক্তারের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হচ্ছে কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখায় বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত আসন সংখ্যা ৩শ। অথচ অধ্যক্ষ সিন্ডিকেট করে ২৩৭ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। অর্থাৎ ৩০০-এর স্থলে ৫৩৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। ভর্তির জন্য তারা জনপ্রতি ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা করে ঘুস গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ক্লাসে পর্যাপ্ত জায়গা না হওয়ায় অধ্যক্ষের সিন্ডিকেটের কিছু শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে মাস্টারপাড়ায় কোচিং বাণিজ্য শুরু করেছেন। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির এই অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড পরিদর্শন ও অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় কলেজের পরিদর্শক মো. জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেন এবং রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করেন। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, নোয়াখালী সরকারি কলেজের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখায় ৩০০ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই আসন সংখ্যার বিপরীতে বোর্ড ৩০৯ জনের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে। আবার একই শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে শুধু শূন্য আসনের বিপরীতে অনলাইনে আবেদন করে বোর্ডের অনুমোদনক্রমে ট্রান্সফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থী এক কলেজ থেকে আরেক কলেজে ভর্তি হতে পারেন, যা স্বাভাবিক নিয়মে হয়। তবে দ্বাদশ শ্রেণিতে ট্রান্সফারের ব্যবস্থায় অনলাইন সিস্টেম নেই। অফ লাইনে এই ভর্তি কার্যক্রম হয়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অধ্যক্ষ সালমা আক্তার, তার সিন্ডকেট এবং বোর্ডে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় বড় অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৫৩৭ জনকে ভর্তি করেছেন। দুদকের ভর্তি প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, যদি কোনো শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণিতে ট্রান্সফারের মাধ্যমে ভর্তি হতে চায়, তবে যে কলেজে অধ্যয়নরত, সে কলেজের অধ্যক্ষের কাছ থেকে এ মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হয়। ভর্তি-ইচ্ছুক কলেজে আসন ফাঁকা এবং বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে ছাড়পত্র ইস্যু হয়ে থাকে। এরপর শিক্ষার্থী যে কলেজে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, ওই কলেজের অধ্যক্ষও প্রত্যয়ন করবেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, নোয়াখালী সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখায় ভর্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নিয়ম অধ্যক্ষ সালমা আক্তার বা কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ অনুসরণ করেননি। তিনি শূন্য আসন না থাকার পরও অতিরিক্ত ২৩৭ জন শিক্ষার্থীকে ফরোয়ার্ডিং দিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে ভর্তি করেছেন। বিনিময়ে নিয়েছেন জনপ্রতি ৪০ হাজার টাকা করে ঘুস। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে দুদক দেখতে পায়, দুটি স্মারকপত্রে এই ভর্তির দুর্নীতি করা হয়েছে। এ দুটি নথিতে নোয়াখালী সরকারি কলেজের ২৩৭ জন এবং ফেনী সরকারি কলেজে একইভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করে ভর্তি করা ৪৩৫ জন শিক্ষার্থী আছে। অন্য একটি নথিতে বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যার অতিরিক্ত প্রায় ১৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পাওয়া যায়। যেখানে বোর্ডের অনুমোদন ও অধ্যক্ষের সুপারিশ রয়েছে। এ বিষয়ে উপস্থিত জিজ্ঞাসাবাদ দুদক গোপন তদন্ত করে জানতে পারে, ‘এই ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ঘুস লেনদেন হয়েছে। এই লেনদেনের সঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ সালমা আক্তার ও তার অনুগত কয়েকজন শিক্ষক এবং কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত আছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ও উপকলেজ পরিদর্শক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ক্ষমতাধর পরিচালক জড়িত বলে জানা যায়। ভর্তি বাণিজ্যের বিষয়ে দুদক প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সরেজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধ্যক্ষ সালমা আক্তার সরাসরি জড়িত। এছাড়া কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক, উপপরিদর্শক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অনুসন্ধান করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ভর্তি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আয় করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের জন্য অধ্যক্ষ সালমা আক্তারের বিরুদ্ধে সম্পদের প্রকাশ্য অনুসন্ধান করা যেতে পারে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সালমা আক্তার রোববার রাতে বলেন, রাজনৈতিক চাপে নির্ধারিত ছাত্রের বাইরেও কিছু ভর্তি আমাদের নিতে হয়েছে, এটা ঠিক। শুধু যে আমার আমলে এই অতিরিক্ত ভর্তি, তা কিন্তু নয়। এর আগের রেকর্ডপত্র দেখেও মনে হয়েছে, এই কলেজে অতিরিক্ত ভর্তি হয়েছে। তবে নির্ধারিত ফির বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। আর অতিরিক্ত ভর্তির বিষয়ে বোর্ডের ভূমিকাই বেশি। ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগটি মোটেও সঠিক নয়। নকল উন্মুক্ত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এই অধ্যক্ষ বলেন, পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে। তবে ৭ শিক্ষক লাঞ্ছিত বলতে তর্কাতর্কি হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এলাকার কিছু ছেলে এমন ঘটনার সঙ্গে আগে যুক্ত থাকলেও এখন নেই। বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসক ও লোকাল থানায়ও লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের বলেন, দুদকের প্রতিবেদনে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ও উপকলেজ পরিদর্শকের যোগসাজশের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ, এ দুজন কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে এক গ্লাস পানিও খান না। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় কলেজের একটি অংশ জড়িত থাকতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১০-২০ শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তির বিষয়টি মেনে নেওয়া যায়। কারণ, স্থানীয়ভাবে অনেক তদবির থাকে। কিন্তু ২৩৭ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি অগ্রহণযোগ্য। নকল উন্মুক্ত রাখার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু ছেলে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি দেখা হবে। অভিযোগকারীকেই হয়রানি : কলেজের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করে ফেঁসে গেছেন শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি শিক্ষা ক্যাডারের ৩৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। দুদকের অনুসন্ধানের খবর পেয়ে অধ্যক্ষ সালমা আক্তার অভিযোগকারীকে দাপ্তরিক হয়রানি করছেন। তিনি ৫ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগে তাকে মানসিকভাবে অসুস্থও বলেছেন। এ চিঠি পেয়ে সচিব মেধাবী ও সৎ শিক্ষক হিসাবে পরিচিত আব্দুর রাজ্জাককে খাগড়াছড়ি রামগড় সরকারি কলেজে বদলি করেন। তার বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিভাগীয় মামলা চালু করেছেন।