নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে শিক্ষক-অভিভাবকরা


প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিভিন্ন শ্রেণির নতুন কারিকুলামে নানা ত্রুটি তুলে ধরে তা বাতিলের দাবিতে অভিভাবক ও শিক্ষকরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কারিকুলামে নতুন এমন কিছু চ্যাপ্টার যুক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেমানান বলে মনে করে তারা। চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সিলেবাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এছাড়া আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণির সিলেবাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এনে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়। এই কারিকুলাম বাতিলের দাবি নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকরা মানববন্ধনসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। হঠাৎই তাদের ওপর নেমে আসে মামলা ও গ্রেফতারের ঝড়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারী শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলে হয়রানির মুখে পড়েন তারা। মামলা ও গ্রেফতারের মুখে আন্দোলন দমে গেলেও হয়রানি তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তারা শিক্ষা কারিকুলামের সমালোচনা করে পোস্ট দিয়েছেন, তাতে বিরূপ মন্তব্য করেছেন অনেকেই। ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করার অভিযোগ এনে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করে এনসিটিবি। মামলায় ৭ জনের পরিচয় উল্লেখ করে ৫৭ জনকে আসামি করা হয়। যাদের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’ উল্লেখ থাকায় আরও অনেক শিক্ষক ও অভিভাককে গ্রেফতারের জন্য নিয়মিত অর্ভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানের মুখে অনেকেই ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেক অভিভাবকের সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) জানায়, ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামিদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনকে শনাক্ত করেছে তারা। অনেককে রাখা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, সরকার যেভাবে অভিভাবক-শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে তা নজিরবিহীন। যে অভিভাবক ও শিক্ষকরা আদালত চিনতেন না, তারা এখন আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। জেল খাটছেন। নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের চলমান আন্দোলন সামলাতেই শিক্ষা বিভাগ মামলা ও গ্রেফতারের পথ বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। তবে এনসিটিবি বলছে, অপপ্রচার বন্ধে মামলা করা হয়েছে। এদিকে মামলার পর আন্দোলনকারীদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেকে সপরিবারে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রেফতারকৃতদের পরিবারও রয়েছে আতঙ্কে। মিরপুরের বাসিন্দা গৃহশিক্ষক মো. গোলাম রাব্বী গ্রেফতারের পর তার পরিবার আত্মগোপনে চলে গেছে। গত শনিবার তার মিরপুর-২ এর মনিপুর এলাকার ৭৮২/এ নম্বরের বাসায় গিয়ে দরজায় তালা ঝুলতে দেখা যায়। ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাসুদ বলেন, ছয়তলা ভবনের পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন গোলাম রাব্বী স্যার। তাকে গ্রেফতারের পর বাসায় তালা দিয়ে তার স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় চলে গেছেন জানি না। গত মাসে গোলাম রাব্বীর এক ভাই এসে বাসা ভাড়া দিয়ে গেছেন বলেও জানান তিনি। মামলার পর উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন পেয়েও ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন তাপসী খান নামে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক অভিভাবক। ফেসবুকে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি পেইজ খুলে সংগঠিত হয়েছিলেন অভিভাবক-শিক্ষকরা। সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক এবং রাজধানীর বনশ্রীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাখাল রাহা বলেন, সন্তানদের ওপর চাপানো কারিকুলাম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার শিকার হলাম। গ্রেফতার হয়রানি, রিমান্ড, আদালত, জেলহাজত এগুলোর সঙ্গে আসলে অভিভাবকরা পরিচিত নন। গ্রেফতারকৃত অভিভাবক-শিক্ষকদের রিমান্ডেও নেওয়া হলো, এটি ন্যক্কারজনক। তিনি আরও বলেন, নতুন কারিকুলামে আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা তো কথা বলবই। সরকারের উচিত আমাদের কথা শোনা। শিক্ষক-অভিভাকদের অভিযোগের বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ফেসবুকে বাইরের দেশের কারিকুলামের ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। আমাদের কারিকুলামে যা নেই তাও বলা হয়েছে। আন্দোলনের নামে অপপ্রচার বন্ধেই মামলা করা হয়েছে, কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়নি। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার বিষয়টিকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধ উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল থানায় দুটি মামলা করে এনসিটিবি। ২৩ অক্টোবর ও ২১ নভেম্বর করা দুই মামলার বাদী এনসিটিবির সহকারী সচিব (প্রশাসন) মো. আলমগীর হোসেন। মামলায় ৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয়ের ৫৭ জনকে আসামি করা হয়। বিভিন্ন নামের ফেসবুক পেইজের লিংকও মামলায় উল্লেখ করা হয়। কিছু নামের ফেসবুক পেইজ ফেইক (ভুয়া) বলে দাবি করা হয়। মামলায় আরও বলা হয়, বেশকিছু ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপের লিংক দিয়ে বলা হয়েছে, কতিপয় জ্ঞাত ও অজ্ঞাত কোচিং ব্যবসায়ী উল্লেখিত ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপ থেকে বিকৃত, বিভ্রান্তকর, উসকানিমূলক তথ্য ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে জনগণের মনে ভীতি সঞ্চার করছে। এদের বেশিরভাগই ফেইক আইডি ব্যবহার করছেন। মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, মামলা দুটির তদন্ত চলমান। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার পাঁচজন কারাগারে আছেন। ঘটনায় জড়িতদের আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুই মামলায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন-রাজধানীর মহানগর আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুগদার বাসিন্দা কাজী সাইফুল হক ওরফে পনির (৫২), মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. আল আমিন হোসেন, শান্তিবাগের বাসিন্দা শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (২৯), মিরপুরের বাসিন্দা গৃহশিক্ষক মো. গোলাম রাব্বী (৩৭) ও মতিঝিলের বাসিন্দা মো. আবুল হাসনাত কবির (৫১)। একাধিক আন্দোলনকারী বলেন, শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক-শিক্ষকরা তাদের মতামত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জানিয়ে চরম বিপাকে আছেন। আন্দোলন সামলাতে সরকার মামলা-গ্রেফতার হয়রানির পথ বেছে নিয়েছে বলে অর্ভিযোগ করেন তারা। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে আমাদের সন্তানরা কিছুই শিখছে না। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমরা শিক্ষাক্রমের প্রতিবাদ করায় এখন মামলা-হয়রানির শিকার হচ্ছি। গত ২৪ নভেম্বর জাতীয় শহিদ মিনারে অভিভাবকদের একটি সমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু তার আগের রাতেই আন্দোলনসংশ্লিষ্ট জাহাঙ্গীর ও সাইফুল নামের দুজনের ফেসবুক আইডি থেকে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের গ্রুপে কর্মসূচি স্থগিত বলে পোস্ট আসতে থাকে। পরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে তারা। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, আগের রাতে পুলিশ জাহাঙ্গীর ও সাইফুলকে গ্রেফতার করে। তারা সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন ফেসবুক গ্রুপের এডমিন ও মডারেটর ছিলেন। গ্রুপটি পরে অকার্যকর হয়ে যায়। বর্তমানে শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের (শিশির) ফেসবুক গ্রুপে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। তবে মামলা-গ্রেফতারের ভয়ে তাদের অন্য সব কর্মসূচি স্থবির রয়েছে।