অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত মাগুরা।


শীত এলেই মাগুরাতে হাজার হাজার পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসে বিদেশি অতিথি পাখিরা। উষ্ণতার খোঁজে আসা এসব পাখির কলকাকলিতে মুখরিত মাগুরা জেলার বিভিন্ন স্থান। খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে আসে এই পরিযায়ী পাখিরা। এসময় রোজ ভোরে পাখির কিচির মিচিরে এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে। অতিথি পাখিদের মনোরম উপস্থিতিতে মাগুরার প্রকৃতিতে এনেছে নতুন রূপ। তাদের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। আবার ভিনদেশি এ সব পাখি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন বয়সি মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। মাগুরা সদর উপজেলার সত্যপুর গ্রাম এখন পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য। গত কয়েক বছর ধরে গ্রামের গাছে গাছে দেখা মিলছে এসব পাখিদের। কলকাকলিতে মুখর পুরো গ্রাম। এখন অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত পেয়েছে গ্রামটি। এছাড়াও মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ঘোপ বাওড় ও ইছামতির বিল সহ বিভিন্ন স্থানে শীত এলেই এইসব বিদেশি পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলছে বিস্তীর্ণ জলাশয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে। সরেজমিনে দেখা যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে নানা প্রজাতির অতিথি পাখিদের ডানা মেলে উড়া, পানিতে ডুব দিয়ে আহার শিকার করার মতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মনে হয় যেন দল বেঁধে নেমে পড়েছে খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতায়। এরকম খাদ্যের অভিযান ও ছুটোছুটি আর লুটোপুটি চলে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। আবার কচুরিপানার ওপরে বসেও বিশ্রাম নিতে দেখা যায় পাখিদের। চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছুটে আসেন বাওড়ের তীরে। আগত ব্যক্তিরা দূর থেকেই দুচোখ ভরে উপভোগ করেন পাখিদের কলরব, মিতালী আর মাতামাতি। যা অন্যরকম এক অনুভূতি। সত্যপুর গ্রামে ঠাকুর বাড়ি এলাকার বড়-বড় গাছগুলোতে বসেছে অতিথি পাখির দল। বিশেষ করে বিকেল হলেই বিভিন্ন এলাকার মাঠ থেকে অতিথি পাখিরা এসব গছের শাখায় অবস্থান নেয়। যা হয়ে উঠছে অত্যন্ত দৃষ্টি নন্দন। সত্যপুর গ্রামের স্থানীয়রা জানান, গত ৭ বছর ধরে পাখিগুলো তাদের গ্রামে আসতে শুরু করেছে। তারা ঠাকুর বাড়ি এলাকার বড় গাছগুলোতে অবস্থান করছে। প্রথম দিকে পাখিগুলো শীত মৌসুমে এসে চলে যেত। কিন্তু বর্তমানে এগুলো ১২ মাস ধরে গ্রামেই অবস্থান করছে। এলাকাবাসী পাখিগুলো সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তারা এলাকায় পাখি নিধন নিষিদ্ধ করেছেন। এ কারণে অতিথি পাখিগুলো খুব নিরাপদে এ গ্রামে অবস্থান করতে পারছে। সারা দিন তারা বিভিন্ন মাঠে খাবার গ্রহণের পর বিকেলে আবার নির্দিষ্ট গাছে ফিরে আসে। এগুলো দেখতে প্রতিদিন বিকেলে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষজন। স্থানীয় পাখিপ্রেমীদের ভাষ্যমতে, উড়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বেশি দেখা যায় পাতি সরালি। উপজেলার নালিয়ার বিল, কাতলাশুরের বিল, ইছামতির বিল, ফলিয়ার বিল সহ বিভিন্ন খাল-বিল, জলাশয় ও নদীর অববাহিকায় এসব পাখির বিচরণ দেখা যায়। পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রজাতির পাখি শীতপ্রধান দেশ থেকে খাবার ও উষ্ণতার জন্য হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এদেশে চলে আসে। বালিহাঁস, সারস পাখি, ডুবুরি পাখি সহ নানা পরিযায়ী পাখির সঙ্গে দেশীয় পাখির কলকাকলিতে প্রতি বছরের এসময় মুখরিত হয়ে ওঠে মাগুরার ঘোপ বাওড়। পাখিগুলো এখন এলাকার পরিবেশ ও সৌন্দর্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এটি এখন এ গ্রামের সম্পদ। যে কারণে সবাই এগুলো সংরক্ষণে সমানভাবে উদ্যোগী হয়েছে। অনেকের মতে, এগুলো স্থানীয়ভাবে শামুকভাঙ্গা পাখি হিসেবে পরিচিত। পাখির সংখ্যা কমপক্ষে ৫ শতাধিক হবে। এলাকার মানুষ এগুলো সংরক্ষণে ভূমিকা রাখায় দীর্ঘদিন ধরে এখানে তারা অবস্থান করছে। পাখিগুলো ঝড় বৃষ্টির সময় খুব সমস্যায় পড়ে মর্মে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাখিগুলির বছর ধরে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানান, অতিথি পাখির সংরক্ষণে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছি। শুধু সত্যপুর নয় ঘোপ বাওর সহ গোটা জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাখি নিধনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমরা প্রচারপত্র ও বিভিন্ন ধরনের ব্যানার সরবরাহ করেছি। পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভাই বাড়ায় না, ভারসাম্যও রক্ষা করে। পোকা মাকড় খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে। পাখির প্রতি মানুষের প্রেমে ঘাটতি না থাকলেও এক শ্রেণির শিকারি এর ব্যত্যয় ঘটায়। তাই অতিথি পাখি শিকার বন্ধে প্রশাসনের প্রতি আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবি করেছেন স্থানীয়রা। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুতেই রয়েছে ভিন্ন রূপ। শীত ঋতুর বিশেষত্ব পরিযায়ী পাখি। এর উপস্থিতি শীতের প্রকৃতিতে আনে নতুন মাত্রা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীত ও তুষারপাত থেকে বাঁচতে এসব পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিল, বাঁওড় ও দিঘিতে আশ্রয় নেয়।