দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-২ আসনে তিন লাখ ১৭ হাজার ২৪৭ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ১৮২টি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুলতানা নাদিরা একাই এক লাখ ৪৮ হাজার ৩২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম’র ড. আব্দুর রহমান পেয়েছেন মাত্র ১৯৫১ ভোট। এ আসনের বাকি পাঁচ প্রার্থী মিলে পেয়েছেন অবশিষ্ট পাঁচ হাজার ৩৬২ ভোট। এ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী সাতজনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী। সুলতানা নাদিরা বাদে বাকি সব প্রার্থী এত কম ভোট পাওয়ায় তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে এ আসনে ৪৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট পড়েছে।
প্রায় একই ধরনের চিত্র সিরাজগঞ্জ-১ আসনে। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ-সদস্য তানবির সাকিল জয় দুই লাখ ৭৮ হাজার ৯৭১ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. জহিরুল ইসলাম পেয়েছেন মাত্র ৩১৩৯ ভোট। এ আসনে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭২ ভোটের মধ্যে পড়েছে দুই লাখ ৮৫ হাজার ৪২৩টি। ভোট পড়ার হার ৭২.৩২ শতাংশ। তানবির সাকিল জয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থীর সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
শুধু বরগুনা-২ বা সিরাজগঞ্জ-১ আসন নয়, এমন ১৫৫টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচনে তারা এত বেশি ভোট পেয়েছেন যে, জয় পেতে তাদের কোনো বেগই পোহাতে হয়নি। অঙ্কের হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাদের অর্ধেক বা তারও কম ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ জয়ী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জামানতের টাকাও রক্ষা করতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী, প্রদত্ত ভোটের এক-অষ্টমাংশ না পেলে ওই প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টির ছয়জন এবং স্বতন্ত্র ৯ জন প্রার্থীও বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। এই হিসাবে ফলাফল ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ১৭০টিতেই তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি।
একাধিক নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। এ কারণে অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয় ভোটের আগেই অনেকটা নিশ্চিত ছিল। এ কারণেই যারাই ভোট দিতে গেছেন, তারা জয়ী প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী ছিলেন। অন্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সেটি নষ্ট করতে চাননি। এ কারণে ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি হয়েছে।
রোববার ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ হয়। সোমবার ২৯৮টি আসনের ফলাফল একীভূত করে নির্বাচন কমিশন। ওই ২৯৮ আসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। দেশের ২৯৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ঢাকা-১৫ আসনে। এ আসনের ভোট পড়ার হার ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
নির্বাচনে প্রার্থীরা যে সংখ্যক ভোট পেয়েছেন ফলাফলে তাই রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল সোমবার ইসিতে নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, কারও যদি ফলাফল নিয়ে সন্দেহ-দ্বিধা থাকে, ইউ ক্যান চ্যালেঞ্জ ইট এবং এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। রেজাল্টগুলো আসছে, যদি মনে করেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম; ওটাকে চ্যালেঞ্জ করে আমাদের অসততা আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
জয়ী প্রার্থীর ভোটের অর্ধেকের কম নিকটতম প্রার্থীর : ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৫৫ জন প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। তারা সংশ্লিষ্ট আসনের বৈধ ভোটের সিংহভাগ একাই পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ময়মনসিংহ-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শরীফ আহমেদ। তিনি পেয়েছেন দুই লাখ ৬৩ হাজার ৪৩১ ভোট। তার নিকটতম স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শাহ শহীদ সরোয়ার পেয়েছেন মাত্র ১২ হাজার ১৫ ভোট। এ আসনের ৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৪৫ ভোটের মধ্যে পড়েছে দুই লাখ ৮৫ হাজার ১৬৭টি। ভোট পড়ার হার ৫২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
একইভাবে অন্য যেসব আসন রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-পঞ্চগড়-১ ও ২; ঠাকুরগাঁও-১ ও ২; দিনাজপুর-২, ৩, ৫ ও ৬; নীলফামারী-১ ও ২; লালমনিরহাট-৩; রংপুর-৪ ও ৬; কুড়িগ্রাম-৪; গাইবান্ধা-৩ ও ৪; জয়পুরহাট-১ ও ২; বগুড়া-৫, ৬ ও ৭; চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩; নওগাঁ-১, ৩ ও ৫; রাজশাহী-৩ ও ৪; নাটোর-৩, সিরাজগঞ্জ-২, ৩, ৪ ও ৬; পাবনা-২, ৪ ও ৫; কুষ্টিয়া-৩; যশোর-১ ও ৪; মাগুরা-১ ও ২; নড়াইল-১ ও ২; বাগেরহাট-১, ২ ও ৪; খুলনা-১, ২ ও ৩; সাতক্ষীরা-১, ২ ও ৪; পটুয়াখালী-২; ভোলা-১, ২ ও ৪; বরিশাল-১ ও ৫; ঝালকাঠি-১ ও ২; টাঙ্গাইল-১, ২ ও ৬; জামালপুর-১, ২, ৩ ও ৫; শেরপুর-২, শেরপুর-৩: ময়মনসিংহ-২ ও ১০; নেত্রকোনা-১, ৪ ও ৫; কিশোরগঞ্জ-৪ ও ৬: মানিকগঞ্জ-৩; মুন্সীগঞ্জ-২; ঢাকা-২, ৩, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭; গাজীপুর-৪; নরসিংদী-২; নারায়ণগঞ্জ-১, ২, ৩ ও ৪; রাজবাড়ী-২; গোপালগঞ্জ-২ ও ৩; মাদারীপুর-১ ও ২; শরীয়তপুর-১, ২ ও ৩; সুনামগঞ্জ-১, ৩ ও ৪; সিলেট-১, ২, ৩ ও ৪; মৌলভীবাজার-১, ২, ৩ ও ৪; হবিগঞ্জ-৩; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, ৪, ৫ ও ৬; কুমিল্লা-১, ৬, ৮, ৯, ১০ ও ১১; চাঁদপুর-১, ২, ৩ ও ৫; ফেনী-১ ও ২; নোয়াখালী-১, ৪, ৫ ও ৬; লক্ষ্মীপুর-১ ও ২; চট্টগ্রাম-২, ৪, ৬, ৭, ৯, ১২ ও ১৩; কক্সবাজার-২, ৩ ও ৪, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙামাটি।
স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টি : বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পাওয়া স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা হলেন-রংপুর-১ আসনের মো. আসাদুজ্জামান, কুড়িগ্রাম-২ মো. হামিদুল হক খন্দকার, বগুড়া-৩ খান মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদী, বরিশাল-৪ পঙ্কজ দেবনাথ, ময়মনসিংহ-৮ মাহমুদ হাসান সুমন, মানিকগঞ্জ-১ আসনের সালাহউদ্দিন মাহমুদ, হবিগঞ্জ-১ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, হবিগঞ্জ-৪ সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন) ও চট্টগ্রাম-১৫ আসনের আব্দুল মোতালেব।
বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পাওয়া স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা হলেন-রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সাতক্ষীরা-২ মো. আশরাফুজ্জামান, পটুয়াখালী-১ এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, বরিশাল-৩ গোলাম কিবরিয়া টিপু, নারায়ণগঞ্জ-৫ একেএম সেলিম ওসমান এবং ফেনী-৩ আসনে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিল না। এ কারণে তারা বিপুল ব্যবধানের ভোটে জয়ী হয়েছেন।
৮০ আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট : নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ৮০টি আসনে ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসনে তুলনামূলকভাবে ভোট কম পড়েছে। রাজধানীর আসনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঢাকা-১২ আসনে। এ আসনে ভোট পড়েছে ৩০ দশমিক ০৫ শতাংশ। এ আসন থেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, দেশের ২৯৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ঢাকা-১৫ আসনে। এ আগের ভোটের হার ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ঢাকা-১৫ আসনে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৫০৭টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ৪৪ হাজার ৯৩৬ ভোট। ভোটের হার ১৩.০৪ শতাংশ। এ আসনে আওয়ামী লীগের কামাল আহমেদ মজুমদার নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৬৩২ ভোট। তার নিকটতম জাতীয় পার্টির শামসুল হক পেয়েছেন দুই হাজার ৪৪ ভোট।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বরাবরের মতো সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন গোপালগঞ্জ-২ আসনের শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি ভোট পেয়েছেন দুই লাখ ৯৫ হাজার ২৯১ ভোট। তার নিকটতম জাতীয় পার্টির কাজী শাহীন পেয়েছেন এক হাজার ৫১৪ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান দুই লাখ ৯৩ হ্জাার ৭৭৭ ভোট। নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আওলাদ হোসেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ২৪ হাজার ৭৭৫ ভোট। ত্রিমুখী লড়াইয়ে এ আসনে দ্বিতীয় হয়েছেন আওয়ামী লীগের সানজিদা খানম। তিনি পেয়েছেন ২২ হাজার ৫৭৭ ভোট।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই : নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে ঢাকা-৫ আসনে। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল ৫০ হাজার ৬৩১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের হারুনর রশিদ মুন্না পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩৩৪ ভোট। দুই প্রার্থীর ব্যবধান মাত্র ২৯৭ ভোট।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।