‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’


আজ ২০ জনুয়ারি শহিদ আসাদ দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উত্থানপর্বে আইয়ুবশাহীর লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসাদ (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান)। দেশব্যাপী ছাত্র ও গণজাগরণ, শহিদ আসাদ (২০ জানুয়ারি), শহিদ মতিউর (২৪ জানুয়ারি) ও শহিদ ড. শামসুজ্জোহা (১৮ ফেব্রুয়ারি) এভাবেই আইয়ুবের পতন আর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান; আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ও অনুপ্রেরণা। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বর্ধিষ্ণু ধানুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। স্কুলজীবনেই আসাদুজ্জামান ও মনিরুজ্জামান দুই ভাই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নিজ উপজেলা শিবপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান আসাদ। আসাদের বাবা এমএ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ; অসাধারণ মেধাবী এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে স্বনামখ্যাত এমএ তাহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আইটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষিকা। তাদের ধানুয়া গ্রামের বাড়িটি ‘মিয়াজীবাড়ি’ আর আসাদের বাবা ‘তাহের মওলানা সাহেব’ নামে সমধিক পরিচিত। আসাদদের বাড়িটিকে ‘মাস্টারবাড়ি’ বলেও ডাকে অনেকে। বাড়ির আঙিনাতে প্রাচীন মসজিদ। প্রখর মেধার অধিকারী, সৎ ও সজ্জন; ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার বিরল সমন্বয় ঘটেছিল এমএ তাহেরের মধ্যে। ২. শহিদ আসাদের অনুজ এইচএম মনিরুজ্জামান ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে আমার একজন প্রিয় শিক্ষক। নিজের বাবাকে নিয়ে ঘটনাটি স্যারের মুখ থেকেই আমার শোনা। সেটি পাকিস্তান আমল। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ঢাকা থেকে নরসিংদী স্টেশন পর্যন্ত রেলভাড়া (ইন্টার ক্লাস) ছিল ১.২৫ টাকা (এক টাকা পঁচিশ পয়সা)। ইন্টার ক্লাস হলো রেলের বিন্যাস অনুযায়ী তৃতীয় ধাপ (ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস ও থার্ড ক্লাস)। যে কোনো কারণেই হোক, একবার ঢাকা থেকে বাড়ি আসার সময় রেলের টিকিট কিনতে না পারায় নরসিংদী পর্যন্ত বিনা টিকিটেই আসতে হলো মনিরুজ্জামানকে। একাদশ শ্রেণির ছাত্র, বয়স আর কত; টগবগে তরুণ। বাড়ি যাওয়ার পথে তিনি বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য যথারীতি শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে উঠলেন। প্রধান শিক্ষক বাবা ছেলের কাছে কুশলাদি এবং এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে তার বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের তথ্যটিও জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দপ্তরি আজিজকে ডেকে পাঠান। পকেটে হাত দিয়ে তার হাতে পাঁচ সিকা (১.২৫ টাকা) তুলে দিয়ে স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে সমান মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প কিনে নিয়ে আসতে বলেন। ছেলে মনিরুজ্জামান কাছেই দণ্ডায়মান। প্রধান শিক্ষক ফাঁকে ফাঁকে তার দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্ট্যাম্পগুলো নিয়ে এসে তার হাতে দিতে চাইলে প্রধান শিক্ষক নিজের হাতে না নিয়ে বরঞ্চ আজিজকেই বললেন এর সবকটি ছিঁড়ে ফেলতে। স্কুলের শিক্ষকরা যার যার কাজে মগ্ন, কক্ষে কক্ষে যথারীতি ক্লাস চলছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রধান শিক্ষকের অফিসকক্ষে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! নিজের সন্তানকে শুনিয়ে যে দু-তিনজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, সবার উদ্দেশে প্রধান শিক্ষক বলে চলেন-‘যে কোনো কারণেই হোক রেলের টিকিট তুমি আজ সংগ্রহ করতে পারোনি বলে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেছ। এতে সরকারকে তার পাওনা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। স্ট্যাম্পগুলো ছিঁড়ে ওই পাওনাটুকু পরিশোধ করা হলো। দামটা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।’ ৩. আজ থেকে আড়াই বছর আগে (২২ জুন ২০২১) আমাদের মনিরুজ্জামান স্যার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। স্যারের বাবা (১৯৯৬ সালে প্রয়াত) ও মা (১৯৯৫ সালে প্রয়াত) এবং স্কুলজীবন আর প্রিয় দুজন শিক্ষককে নিয়ে লেখা। এতে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে স্যারের গর্ভধারিণী মায়ের কথা। পোস্টটি এমন : ‘সেটি পঞ্চাশ দশকের শেষদিককার কথা। সেভেন-এইটে পড়ার সময় শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্র চন্দ্র সেন আমাদের বাংলা পড়াতেন। তিনি ছিলেন সাধু চরিত্রের মানুষ। বিরতির সময় মুসলিম ছাত্ররা নামাজ পড়ত। এ ৪০ মিনিট সময় একটি নির্জন কক্ষে একাগ্রচিত্তে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বাড়ির বাইরে জলও স্পর্শ করতেন না। বীরেন্দ্র স্যারের ছোট ভাই সুধীর চন্দ্র সেন বিএসসি ছিলেন একেবারে বিপরীত স্বভাবের, এমনকি তিনি গোমাংসও খেতেন। দুই ভাইকে নিয়ে নানা রকমের গল্প প্রচলিত ছিল। বীরেন স্যার ছিলেন অনেক লম্বা, সুধীর স্যার অনেকটাই খাটো। স্কুলে আসার পথে একটি সাঁকো ছিল। সাঁকোটি ভেঙে যাওয়ায় নিচ দিয়ে যাতায়াত করার সময় পথচারীদের কাপড় ভিজে যেত। বীরেন স্যার একটা গামছা পরে জায়গাটা পার হতেন। কিন্তু সুধীর স্যার বেশ নিঃসংকোচে সেই গর্ত পার হয়ে আসতেন, শুধু দাদার পেছনে হাঁটতেন। জামা-কাপড় শুকনোই থাকত। বীরেন্দ্র স্যারের কাছে সংস্কৃত পড়তাম। আমরা সব ভাই বাবার স্কুলে বীরেন স্যার ও সুধীর স্যারের ছাত্র ছিলাম। আমি তখন আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষকতায় আর মেজভাই (ডাক্তার) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায়। বীরেন স্যার খুব অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলেন। স্যারের চিকিৎসায় বড় সমস্যা দেখা দিল-তিনি বাইরের কোথাও কিছু খাবেন না। স্যার আমার বাবার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। বাবা একই স্কুলের হেডমাস্টার, বাবার অনুরোধও রাখলেন না। না খেয়ে তার শরীর দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। আমার মা সব জেনে স্যারের জন্য খাবার-পথ্য তৈরি করে নিজে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। স্যারকে বললেন-‘আপনার বোন নতুন বাসনপত্র কিনে, অন্যের কোনো স্পর্শ ছাড়া নিজ হাতে সব তৈরি করে নিয়ে এসেছে; আপনাকে তা খেতেই হবে।’ আমার মায়ের শাস্ত্রটাস্ত্রও কিছু পড়া ছিল, সেসব উদ্ধৃত করলেন। সে সময়ে অনেক কিছুই তাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। মায়ের কথা শুনে স্যারের দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, শীর্ণ হাত দুটি দিয়ে আমার মায়ের হাত দুটি ধরলেন এবং বললেন, ‘বোন, আমি তোমার আনা, তোমার রান্না করা খাবার খাব; এ খাবার আমার জন্য অমৃত।’ স্যার সেবার সুস্থ হলেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। স্যারের বয়স তখন ৮০-র বেশি ...।’ ৪. মা ও বাবার এমন আদর্শের ছোঁয়ায় সন্তানরাও গড়ে ওঠে। তাহের-মতিজাহান দম্পতি এমনই সৌভাগ্যবান, সেরা সেরা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা শেষে ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে প্রত্যেককেই তারা যার যার কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হিসাবে দেখে যেতে পেরেছেন। শহিদ আসাদসহ তাদের দুই ছেলে (ইতিহাস বিভাগ) ও দুই মেয়ে (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দুই ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সবার বড় কেএম খুরশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ছেলে এফএম রশীদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। খুবই গৌরবের কথা, আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও এর নকশা তৈরিতে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সহযোগী হিসাবে দেশীয় প্রকৌশলী রশীদুজ্জামানেরও (শহিদ আসাদের পিঠাপিঠি অগ্রজ) অংশগ্রহণ রয়েছে। সরকার শহিদ আসাদকে ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেছে। আসাদ আমাদের অনুপ্রেরণা। কবি শামসুর রাহমান তাকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’। আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধাভরে শহিদ আসাদকে স্মরণ করি। বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, কলাম লেখক