এডিপি থেকে বাদ যাচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধাক্কায় স্থবিরতা বিরাজ করছে উন্নয়ন প্রকল্পে। আর সেই প্রভাবে রেকর্ড বরাদ্দ কমছে বৈদেশিক সহায়তার অর্থ। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কাটছাঁটের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। গত সপ্তাহে পাঠানো প্রস্তাবে সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) মোট বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ খাতে বর্তমানে রয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। করোনা মহামারির সময়ও এত বরাদ্দ কমানো হয়নি বলে জানা গেছে। তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার বাড়িয়ে পাইপলাইন কমানোর তাগিদ দিয়েছেন নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালাম। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই তিনি এমন তাগিদ দেন। তিনি বলেন, তার প্রধান লক্ষ্যই থাকবে বৈদেশিক অর্থপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়িয়ে পাইপলাইনের অর্থ খরচ কমানো। এ প্রসঙ্গে সদ্য সাবেক হওয়া পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মঙ্গলবার বলেন, নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন আমি তার সঙ্গে একমত। কেননা আমাদের এই সময় বৈদেশিক অর্থের প্রয়োজন। সেখানে যদি উলটো এত পরিমাণ বরাদ্দ কমাতে হয় সেটি ঠিক হবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জনগণের জন্য কাজে লাগে এমন প্রকল্প নেওয়া হয় না। কখনও বিশ্বব্যাংক ও এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শে তড়িঘড়ি করে বৈদেশিক ঋণে প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে এসব প্রকল্পে নানা সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, গুরুত্ব অনুযায়ী প্রকল্প বাছাই আমাদেরকেই করতে হবে। ইআরডি ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, গত বছরের ২২ অক্টোবর থেকে সংশোধিত এডিপি তৈরিতে বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে ইআরডি। ওই সময় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসের ব্যয় বা বাস্তবায়ন অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে বরাদ্দ প্রস্তাব চাওয়া হয়। পরে ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে ইআরডি। এক্ষেত্রে ১০ ডিসেম্বর শুরু করে ১১, ১৩ এবং ১৪ ডিসেম্বর ৪ দিনে ৫২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে ইআরডি। এরপরই কাটছাঁটের বিষয়টি চূড়ান্ত করে সংস্থাটি। গত সপ্তাহে বরাদ্দ কমিয়ে নতুনভাবে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। ইআরডির এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার বলেন, এবার কেন এত টাকা কমানো হচ্ছে সেটি আমরাও পরিষ্কার নই। তবে যখন বরাদ্দ নেওয়া হয় তখনই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বেশি নিয়ে থাকে। এটা ঠিক নয়। কেননা বরাদ্দ নেওয়ার ক্ষেত্রে যতবেশি উৎসাহ দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে তত কম আগ্রহ থাকে সংশ্লিষ্টদের। সেই সঙ্গে অর্থবছরের শেষ দিকে তড়িঘড়ি বাস্তবায়নের রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এদিকে চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করতে পারেনি অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। মোট বরাদ্দ ৯৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ২৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত এক টাকাও খরচ করতে পারেনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়। বৈদেশিক অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে এখনো ৫ শতাংশের নিচে এডিপি বাস্তবায়ন হার রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, নির্বাচনের আগে থেকেই অর্থব্যয়ের কিছুটা সতর্কাবস্থান ছিল সরকারের। সেটি এখনো আছে। যেমন আইএমইডির একটি গাড়ি কেনার কথা ছিল, কিন্তু সেটি চিঠি দিয়ে নিষেধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরকম চলমান সংকট এবং জাতীয় নির্বাচনের কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হয়েছে। তবে এখন নতুন অর্থমন্ত্রী এসেছেন। তিনি গুরুত্ব বুঝে প্রকল্পের বরাদ্দ নিশ্চিত করবেন বলে আশা করছি। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরই এডিপিতে যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দ থাকে সংশোধিত এডিপিতে এসে কমানো হয়। এরপরও অর্থবছর শেষে সেটিরও শতভাগ খরচ করতে পারছে না মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ঋণের এ অর্থ ব্যয় না হওয়ার নেপথ্যে ৮৬টি কারণ খুঁজে পেয়েছে আইএমইডি। আইএমইডি সূত্র জানায়, গত অর্থবছর (২০২২-২৩) এডিপি থেকে বরাদ্দ কমেছিল ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ওই বছর এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে কমেছিল ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা, পরে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এর আগে করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাদ দেওয়া হয় ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। সেটি ছিল ওই সময়ের সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমানো হয় ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়য়েছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাটছাঁট হয়েছিল ৮ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।