যত দোষ কোলেস্টেরলের!
অনলাইন নিউজ ডেক্স
মনে করেন আমি কোলেস্টেরল। মানুষসহ সব প্রাণীর শরীরে আমার বসবাস। প্রাণী সৃষ্টির শুরুর দিকে আমার সৃষ্টি হয় এবং আমাকে কিছু কঠিন কাজ দিয়ে সব প্রাণীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। লাখ লাখ বছর ধরে আমি আমার সেসব দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করে আসছিলাম। কিন্তু গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে অতিবুদ্ধিমান মানবসম্প্রদায় আমাকে তাদের শরীরের এক প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছে-আমি নাকি চর্বি-জগতের সবচেয়ে খারাপ চর্বি, আমি নাকি মানুষকে মোটা করে ওদের বিভিন্ন রোগ-শোক বাড়িয়ে দেই, ওদের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেই, ওদের হার্ট আর ব্রেনের ধমনি ব্লক করে দেই, ওদের ডায়াবেটিস বাঁধিয়ে দেই-এ ধরনের হাজার রকমের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। তাই মানুষরা আমার বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধই ঘোষণা করেছে-আমার মতো ‘ক্ষতিকর’ জিনিসকে খাওয়া যাবে না, ওষুধ দিয়ে আমাকে শরীর থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে-কত রকম পরিকল্পনা আমাকে নিয়ে!
অথচ আধুনিক যুগের মানুষ খুব ভালো করেই জানে যে, আমি না থাকলে তাদের শরীরের কোষগুলোই তৈরি হতো না, শরীরের জীবন ও যৌবন রক্ষাকারী হরমোনগুলো তৈরি হতো না, ভিটামিন-ডি তৈরি হতো না এবং শরীরে ক্ষত সারানোর ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করত না। অর্থাৎ আমি না থাকলে তাদের শরীরই থাকত না, আর শরীর না থাকলে তাদের অস্তিত্বই থাকত না। অথচ এখন সবাই বলছে, আমি নাকি মানুষের শরীরের প্রধান শত্রু! মানুষ তার নিজের কর্ম আর আচরণের কুফলগুলোর সব দোষ এনে ফেলছে আমার ওপর, বিনা দোষে আমাকে বানিয়েছে তাদের শরীরের প্রধান শত্রু। এটা খুবই অন্যায়।
আমি তো লাখ লাখ বছর ধরেই মানুষ ও অন্য প্রাণীর শরীরে আমার কাজ করে যাচ্ছি এবং এতে মানুষ এবং অন্য প্রাণীগুলো ভালোভাবেই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এতকাল ধরে আমার বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগ ওঠেনি-এখন উঠছে কেন? মানুষের শরীরে আমার অতিরিক্ত উপস্থিতি আর আমার কারণে ওদের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার কারণ আমি নাকি অন্য কেউ, সেই কথা মানুষ কি ভেবে দেখে না?
প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী-গোত্রের শরীর ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনে তৈরি করেছে, যেন প্রকৃতিতে একটা ব্যালেন্স তৈরি করে ওরা ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। মানুষের শরীর তৈরি করা হয়েছে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করার জন্য। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষ এখন শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে-এখানে আমার দোষ কোথায়? প্রাকৃতিক খাবারের চেয়ে মানুষ এখন কৃত্রিম কেমিক্যাল সামগ্রী মেশানো অধিক মজাদার ও সহজলভ্য খাবার খাচ্ছে। আজকাল বাবা-মা তাদের সন্তানকে বাইরে থেকে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার এনে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। তারা সারাদিন কম্পিউটার আর সেলফোনে শুয়ে-বসে কাজ করছে এবং ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। এতে মানুষের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমছে, যা ক্যানসার, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের কারণ হচ্ছে-এটা কি আমার দোষ? প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মিষ্টি খাবারের চেয়ে মানুষ এখন কৃত্রিমভাবে বানানো চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি খাবারে দোকানপাট ভরিয়ে ফেলেছে-এই কৃত্রিম চিনি তৈরির দায় কি আমার?
আর আমাকে খাওয়া যাবে না কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে? আমাকে না খেলে কি শরীরে আমার অস্তিত্ব কমে যাবে? গরু-ছাগল আর অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণী তো ঘাস আর লতাপাতা খেয়ে বাঁচে, সেসব খাবারে আমার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তাহলে গরু-ছাগলের শরীরে আমার অস্তিত্ব এত বেশি কেন? আবার মাংসভোজী প্রাণ, যেমন-কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বাঘ, সিংহ-এগুলো তো মাংস-চর্বি ছাড়া আর কিছুই খায় না। কিন্তু ওদের শরীরে আমার অস্তিত্ব এত কম কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর না জেনে আমার ওপর একপক্ষীয়ভাবে মনগড়া দোষ চাপানো কি ঠিক?
প্রাণীদের শরীরে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটা হলো-শরীরের ভেতরে বা বাইরে কোথাও কেটে-ফেটে গেলে আমাকেই প্রথম সেখানে গিয়ে সেই ক্ষত ঢেকে ফেলতে হয়, যেন ক্ষতির মাত্রা আর না বাড়ে। এটা আমার ওপর অর্পিত একটা দায়িত্ব। এরপর শরীরের অন্য উপাদানগুলো এসে শরীরের ভেতরের সিস্টেম অনুযায়ী সেই ক্ষত মেরামত করে। এটা শরীরের ভেতর বিভিন্ন উপাদানের ওপর অর্পিত দায়িত্বের একটা কমপ্লিট চেইন, যা ভাঙার সুযোগ বা ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়নি।
শরীরের ধমনি ও হার্ট আর ব্রেনের ধমনির ভেতরও আমাকে একই কাজ করতে হয়। মানুষ অনিয়ন্ত্রিত আর উশৃঙ্খল জীবনযাপন করে তাদের রক্তচাপ বাড়াবে এবং সে কারণে তাদের হার্ট আর ব্রেনের ধমনির ভেতর ছোট ছোট ফাটল ধরবে এবং আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী সেই ফাটলগুলো আমার শরীর দিয়ে ঢেকে দেব-এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি যদি ধমনির সেই ফাটল না ঢেকে দেই, তাহলে তো উচ্চরক্তচাপে সেই ধমনি ফেটে যাবে এবং জীবন-মৃত্যুর সমস্যা তৈরি হবে-সেটা কি মানুষের জন্য ভালো হবে?
এখন, মানুষ যদি ওদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখে, তাহলে তো ধমনির দুর্বল জায়গাগুলোতে একের পর এক ফাটল ধরতেই থাকবে এবং আমি সেই ফাটলগুলো আমার শরীর দিয়ে ঢেকে দেবই। এতে যদি মানুষের ধমনির ভেতর দিয়ে রক্তপ্রবাহ কমে যায়, তাহলে সেটার জন্য কি আমি দায়ী, নাকি মানুষের অনিয়ন্ত্রিত আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে তৈরি উচ্চরক্তচাপ দায়ী? উচ্চরক্তচাপের একটা অন্যতম কারণ হলো ধূমপান। আর সিগারেটের তামাক পাতা কি আমি বানিয়েছি? নাকি আমি মানুষকে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল, হুক্কা-এগুলো সেবন করতে শিখিয়েছি বা বলেছি ওগুলো সেবন করতে?
আমাকে শত্রু ভেবে বিভিন্নরকম ওষুধ খেয়ে এবং চর্বিহীন খাবার খাওয়া প্র্যাকটিস করে মানুষের শরীরে আমার পরিমাণ সাময়িকভাবে কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমার পরিমাণ বেশি কমে গেলে শরীরে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলোর উৎপাদন, বিশেষ করে স্টেরয়েড হরমোনগুলোর উৎপাদন কমে যেতে পারে, নতুন কোষ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। কাজেই, সবদিক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে; নইলে পরে আম-ছালা দুটিই হারাতে হতে পারে।
আসলে এ সবকিছুর গোড়া হচ্ছে মানুষের লাইফস্টাইল। আমি মানব-সম্প্রদায়কে পরামর্শ দেব সুস্বাস্থ্যের জন্য শরীরের ভেতরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে দোষ না দিয়ে নিজের লাইফস্টাইল ঠিক করতে। খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করে প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে মিলিয়ে রুটিন মতো জীবন চালাতে, যতটুকু সম্ভব বেকারি, ফাস্টফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার পরিহার করে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক খাবার খেতে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ বাদ দিতে এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতে। জীবনের মৌলিক আদর্শ আর আধ্যাত্মিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও টেনশন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে, পজিটিভ চিন্তা করতে এবং প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন চালাতে। তাহলেই মানুষের শরীর অনেক ভালো থাকবে-ডাক্তার, ল্যাব আর ওষুধের পেছনেও সারাক্ষণ দৌড়াতে হবে না।
ডা. শাহীন রায়হান : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।