পানির দাম ২৪-১৪৭% বাড়ানোর উদ্যোগ
অনলাইন নিউজ ডেক্স
আবারও পানির দাম বাড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা। এবার গ্রাহকদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম বাড়াতে চায় সংস্থাটি।
রাজধানীর পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সংস্থা লাভজনক হওয়ার পরও শ্রেণিভেদে ২৪ থেকে ১৪৭ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটা করা হলে ঢাকার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের পানির দাম বাড়বে।
আর ১৫ শতাংশ নিম্ন-আয়ের মানুষের পানির দাম কমতে পারে। সবমিলিয়ে ঢাকা ওয়াসার কয়েক গুণ আয় বাড়বে। সংস্থাটি এবার আরও লাভ বাড়িয়ে শেয়ারবাজারে ঢুকতে চায়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
২১ জানুয়ারি ঢাকা ওয়াসা ভবনে এক আলোচনাসভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর উপস্থিতিতে শেয়ারবাজারে যাওয়ার অনুমোদন প্রত্যাশা করেন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।
তখন তিনি বলেছেন, ঢাকা ওয়াসা সেবাধর্মী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন, তিনি এর শতভাগ বাস্তবায়ন চান। এ লক্ষ্যে কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। মানুষের আয়ের সক্ষমতা অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণ করলে আরও আয় বাড়বে ওয়াসার।
এ অবস্থায় সরকার অনুমোদন দিলে ঢাকা ওয়াসা শেয়ারবাজারে যেতে চায়; সেটা ঢাকা ওয়াসার সমৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসার বর্তমান প্রশাসনের সময় অতিব্যয়ে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী পানি উৎপাদন হচ্ছে না। আর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক ছাড়াই একটি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তা থেকে কোনো রাজস্ব আসছে না।
এছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। সেসব ব্যর্থতা ঢাকতে বারবার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
তাদের আরও অভিমত-ধনী-গরিব কারও ওপরই অযৌক্তিকভাবে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। ঢাকা ওয়াসার স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকরা চুপ থাকেন।
ঢাকা ওয়াসা যেহেতু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি তাদের মাথায় রাখতে হবে। আর শেয়ারবাজারে যাওয়ার মতো উচ্চাভিলাষী চিন্তা থেকে কর্তৃপক্ষকে সরে আসতে হবে। এমন সিদ্ধান্ত নিলে নগরবাসীকে এ সংস্থার ব্যর্থতার চরম খেসারত দিতে হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য বিশ্লেষণ করে পানির দাম নির্ধারণ করতে এরই মধ্যে এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণবিষয়ক কারিগরি সমীক্ষা করেছে।
২০২২ সালে পরিচালিত ওই সমীক্ষার কাজে অংশ নেয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। সেখানে, উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষ-এমন পাঁচটি শ্রেণি করা হয়। এলাকাভিত্তিক দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার মৌজা দর, গৃহকর ও মাসিক আয় বিবেচনায় রেখে পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ দাম বাস্তবায়নে অংশীজনদের মতামতও গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা ওয়াসার পানির দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত কারিগরি সমীক্ষার কাজে যুক্ত ছিলেন ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কর্মকর্তা মো. তাহমিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, পানির দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে ২০২২ সালে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০-এর নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, উচ্চবিত্ত-যারা আড়াই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাসায় থাকেন, উচ্চমধ্যবিত্ত-যারা আড়াই হাজার বর্গফুটের বাসায় থাকেন, মধ্যবিত্ত-যারা ১ হাজার থেকে দেড় হাজার বর্গফুটের বাসায় থাকেন, নিম্নবিত্ত-যারা ১ হাজার বর্গফুটের কম আয়তনের বাসায় থাকেন এবং নিম্ন-আয়ের মানুষ-যারা বস্তিতে বসবাস করেন।
জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা ওয়াসার অনেক ব্যর্থতা ও দুর্বলতা জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে পড়েছে। ড্রেনেজ লাইন না করেই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেখান থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না তারা।
এমনভাবে পদ্মা পানি শোধনাগারসহ কয়েকটি প্রকল্পে ভুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। যেখান থেকে রাজস্ব আয় হচ্ছে না, উপরন্তু পরিচালন ব্যয় ও ঋণের কিস্তি ঢাকা ওয়াসার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি অনিয়ম ও ব্যর্থতা রয়েছে, সেগুলো নিরসনে ঢাকা ওয়াসাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, নাগরিকদের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সার্বিক দিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে এর আগে ঢাকা ওয়াসার অপচয় বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার বিষয়ে নগরবাসীর নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। এজন্য পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে জনমনে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। আর কোনো বিবেচনায় ঢাকা ওয়াসার শেয়ারবাজারে যাওয়া উচিত হবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ধনী-গরিব কারও ওপরই অযৌক্তিকভাবে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। ঢাকা ওয়াসার স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকরা চুপ থাকেন।
ঢাকা ওয়াসা যেহেতু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি তাদের মাথায় রাখতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতা বন্ধ করলে দফায় দফায় পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
তিনি বলেন, দেশে আরও কয়েকটি পানি সরবরাহকারী সংস্থা রয়েছে। তাদের চেয়ে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেশি। ঢাকা ওয়াসাকে পানি উৎপাদনের অহেতুক ব্যয় কমিয়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে। পানি একটি মৌলিক সেবা; ঢাকা ওয়াসাকে সেটা মনে রাখতে হবে, ভুলে গেলে চলবে না।
ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদন ব্যয় : দেশে চারটি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসার পানির উৎপাদন খরচ সবচেয়ে বেশি। কারণ হিসাবে জানা যায়, সংস্থায় জেঁকে বসা অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতা।
ঢাকা ওয়াসার প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা; তারা আবাসিক গ্রাহকদের কাছে প্রতি ইউনিট বিক্রি করছেন ১৫ টাকা ৯৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের কাছে ৪২ টাকা। খুলনা ওয়াসার প্রতি ইউনিট পানি উৎপাদন খরচ ১৬ টাকা ৫০ পয়সা; আবাসিকে বিক্রি করছে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৪ টাকায়। রাজশাহী ওয়াসার প্রতি ইউনিট পানি উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৯০ পয়সা; আবাসিকে ৬ টাকা ৮১ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৩ টাকা ৬২ পয়সায় বিক্রি করছে।
ঢাকা ওয়াসা ও রাজশাহী ওয়াসার উৎপাদন খরচের ব্যবধান প্রতি ইউনিট ১৬ টাকার বেশি। বিক্রিতে ব্যবধান-আবাসিকে ১০ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ২৮ টাকা। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি ইউনিট পানির উৎপাদন খরচ ১৯ টাকা; তাদের ৯০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎসের এবং তা শোধন করা হয়। তারা আবাসিকে বিক্রি করছে ১৮ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ৩৭ টাকা।
ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত ৭৫ শতাংশ গভীর নলকূপের পানি। বাকি ২৫ শতাংশ পাওয়া যায় ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে। ঢাকার শোধন করা পানির খরচ চট্টগ্রামের তুলনায় বেশি; অথচ বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচ একই। খুলনা ওয়াসার ৬০ শতাংশ পানি শোধন করা হয়; এরপরও ঢাকা ওয়াসার চেয়ে সেখানে দাম কম।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।