মাসে এলসি ৫শ কোটি ডলারের নিচে


ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় করতে আমদানিতে কঠোরভাবে লাগাম টানা হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারা পণ্য আমদানির জন্য নতুন এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে সব ধরনের পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমে গেছে। ডিসেম্বরে নতুন এলসি খোলা কমে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে (অর্থাৎ ৪৯২ কোটি ডলার) নেমেছে। যা গত ৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে। এর আগে গত অর্থবছরের এপ্রিলে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে এলসি খোলা হয়েছিল। ২০২২ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ৯৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। এরপর থেকে এলসি খোলা কমেছে। তবে এবার নিয়ে ৩ মাসে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে এলসি হয়েছিল। এলসি কমায় আমদানিও কম হবে। ইতোমধ্যে বিশেষ করে শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি উপকরণের আমদানি কমায় এসব খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে শিল্পোৎপাদন কমে যাচ্ছে। নতুন শিল্প স্থাপন কম হওয়ায় বেকারদের কর্মসংস্থানের গতি একেবারেই শ্লথ। তবে এতে রিজার্ভের সাশ্রয় হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে দেশের আমদানি ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। ওই বছরের মার্চে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি এলসি খোলা হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল ৯৫১ কোটি ডলার। আমদানি মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায়ও রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স কমায় ডলারের প্রবাহ কমে যায়। এতে রিজার্ভ কমতে থাকে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। প্রথমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। এতেও আমদানি নিয়ন্ত্রণে না এলে তা বাড়িয়ে শতভাগ মার্জিন আরোপ করা হয়। এতে আমদানির এলসি কমলেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়। গত বছরের শুরুতে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এখন এলসি খুলতে হলে আগাম ডলারের সংস্থান করতে হবে। কিন্তু রপ্তানিকারকরা আগাম ডলারের সংস্থান করতে পারছেন না। কারণ তারা তাদের আয় করা ডলার নিজেদের প্রয়োজনেই প্রায় শতভাগ ব্যবহার করছেন। কিছু ডলার ব্যাংকগুলো ব্যবহার করতে পারছে; যা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া রেমিট্যান্স বাবদ পাওয়া ডলার জরুরি পণ্য ও সরকারি খাতের আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। ফলে ছোট ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছেন না। এ কারণে তারা নতুন এলসিও খুলতে পারছেন না। এতে সার্বিকভাবে এলসি খোলা যেমন কমেছে, তেমনি আমদানিও কমেছে। গত অর্থবছরে এলসি খোলা কমেছে ২৭ শতাংশ। আমদানি কমেছে ১৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার পরও আমদানি ও এলসি খোলা কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি কমেছে ১৯ শতাংশ ও নতুন এলসি কমেছে ৬ শতাংশ। ২০২২ সালের মার্চ থেকে প্রতি মাসে আমদানির এলসি কমছে। ফলে এখনও তা কমছে। আগে সাধারণত প্রতি মাসে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হতো। গত অর্থবছরে তা ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। তবে নভেম্বর ও এপ্রিলে তা ৫০০ কোটি ডলারের নিচে নামে। পরে আবার বেড়ে ৫০০ কোটি ডলারের উপরে ওঠে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর ছাড়া বাকি সব মাসেই ৫০০ কোটি ডলারের উপরে এলসি হয়েছিল। এর মধ্যে আগস্টে এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় ৬৫০ কোটি ডলারের। এলসি খোলা কমার কারণে আগামীতে আমদানিও কমে যাবে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প ও জ্বালানি খাতে। শিল্পের চাকার ঘূর্ণন কমে যাওয়ার কারণে এর উৎপাদন যেমন কমে যাবে। তেমনি বেকারদের কর্মসংস্থানের হারও কমবে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধিও কমবে। যদিও করোনার পর থেকে গত দুই অর্থবছর ধরেই দেশের অর্থনীতি মন্দার মধ্যে দিয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে এর প্রকট আরও বেড়েছে। ফলে ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব এখন সব খাতে পড়তে শুরু করেছে। ডলার সংকটের কারণে একদিকে এর দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ। ফলে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়ে গেছে বৈদেশিক দায়দেনার পরিমাণও। এ কারণে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সব মিলে মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। গত দেড় বছর ধরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটে ওঠেছে। ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এত কর্মসংস্থানের গতিও কমে গেছে। এদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তারপরও রিজার্ভ কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে ওঠেছিল। এখন তা কমে ২ হাজার ৫৩৩ কোটি ডলারে নেমেছে। তবে নিট রিজার্ভ এখন ২ হাজার কোটি ডলার রয়েছে।