যেভাবেই হোক রোধ করুন ওষুধের দাম বৃদ্ধি


প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম একযোগে বাড়বে, এমন কোনো কথা নেই। তেমনটি ঘটলে এটা কঠিন পরিস্থিতি তাদের জন্য, যারা এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়াতে অক্ষম। এছাড়াও আরও অনেকে আছে, যাদের রোজগার কমে গেছে অর্থনীতি গতি হারানোয়। অনেকে চাকরি হারিয়েছে। ছোটখাটো ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যর্থ। আত্মকর্মসংস্থানে সাফল্য পায়নি। খাদ্যপণ্যের দাম একযোগে বাড়ার এ সময়টায় তাদের কী অবস্থা, যখন আবার ওষুধের দাম বাড়ছে? এদের একাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, অনেকে হৃদরোগী; শ্বাসকষ্ট কিংবা কিডনি জটিলতায় ভুগছে অনেকে। রোগব্যাধির কী আর শেষ আছে! সবচেয়ে বড় কথা, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়মিতভাবে ওষুধ কিনে খেতে হয়। আকার বাড়ছে এ জনগোষ্ঠীর। আর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ওষুধের দাম নতুন করে বাড়ছে। এমন একেকটা অধ্যায় কিন্তু গেছে, যখন জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও ওষুধের দাম বাড়েনি বা তৈরি হয়নি এ নিয়ে শঙ্কা। যেমন, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সময়। এদিকে কোভিড চলাকালে একটা জনগোষ্ঠীর ওপর দিয়ে হঠাৎ করে বাড়তি চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ গেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি তখন অবশ্য বেশি ছিল না। গেল বছর নজিরবিহীন দুর্যোগ গেছে ডেঙ্গু ঘিরে। তখনো চিকিৎসা ব্যয়ের চাপে অনেকে নাস্তানাবুদ হয়েছে। এ সময়টায় কোভিডের মতো লকডাউনে যেতে হয়নি অবশ্য। অর্থনীতি সচল ছিল। মানুষ রোজগার করে বাড়তি চিকিৎসা ব্যয় মিটিয়েছে। তবে এর আগেই বেড়েছে বেশ কিছু ওষুধের দাম। এর মধ্যে ছিল ‘অত্যাবশ্যকীয়’ হিসাবে তালিকাভুক্ত ওষুধও। যেমন, প্যারাসিটামল গ্রুপের ট্যাবলেট ও সিরাপ। এগুলোর দাম দীর্ঘদিন একই জায়গায় ছিল। উৎপাদকদের নাকি পোষাচ্ছিল না ওই দামে। এর পাশাপাশি আরও যেসব ওষুধের দাম বাড়ে, তার ‘ব্যাখ্যা’ ছিল ভিন্ন। এখন যখন নতুন করে দাম বাড়ানো হচ্ছে, তখনো ওষুধ প্রস্তুতকারকরা তুলে ধরছে আগের যুক্তিগুলো। যেমন, অনেক বেশি দামে ডলার কিনে কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। কাঁচামালের উৎসে দাম বেড়ে যাওয়ার যে যুক্তি আগে দেখানো হয়েছিল, সে কথা অবশ্য আর শোনা যাচ্ছে না। ওষুধের কাঁচামালের বেড়ে ওঠা দাম কি কমে আসেনি ইতোমধ্যে? আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক জরুরি পণ্যের দামই কিন্তু কমেছে। দেশীয় বাজারে এর সুফল মিলছে না বলে অভিযোগও আছে। ওষুধের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটছে না তো? এমন তো হতেই পারে, ডলারের দামের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়লেও উৎসে কাঁচামালের দাম কমে আসায় যাচ্ছে পুষিয়ে! কোন ওষুধের কাঁচামাল কোন উৎস থেকে আনা হচ্ছে, সে প্রশ্নও আছে। এ বিষয়ে কোম্পানির বক্তব্য খতিয়ে দেখার কথা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দফায় দফায় ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাদের কাছ থেকে বরাবর যে বক্তব্য পাওয়া যায়, তাতে আশ্বস্ত হওয়া যায় না। ‘অত্যাবশ্যকীয়’ তালিকার বাইরে যে কোনো ওষুধের দাম নির্ধারণ বা বৃদ্ধির বেলায় অধিদপ্তরের সম্মতি নিতে হয়। আর তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার নিজেই। তবে থেকে থেকেই এমন অভিযোগ উঠছে যে, অধিদপ্তরের সম্মতি ছাড়া কোম্পানি নিজেই ওষুধের দাম বাড়িয়ে সেলফোনে জানিয়ে দিচ্ছে বিক্রেতাদের! ওষুধ প্রস্তুতকারকরা অবশ্য অভিযোগটি অস্বীকার করে থাকে। আর অধিদপ্তর বলে, তথ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার যে ঘাটতি রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। ক্রেতারা দোকানে ওষুধ কিনতে এসে দামের রাতারাতি বৃদ্ধি দেখে বিমর্ষ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার তো হতবুদ্ধিকর। তখন তারা শোনে-সামনে দাম আরও বাড়বে! এ অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখে অনেকে। বহুল বিক্রীত কিছু ওষুধের দাম একাধিকবার বাড়ার দৃষ্টান্তও আছে। কোনো কোনোটির দাম বেড়ে আবার কমেছে! এ অবস্থায় ওষুধের ‘প্রাইসিং’য়ের পাশাপাশি মান নিয়েও সংশয় জাগে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কি ক্ষমতা আছে যথাযথ অনুসন্ধান করে মানুষকে সংশয়মুক্ত করার? একই গ্রুপের ওষুধের দাম কোনো কোনো কোম্পানি আবার দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে একবারও বাড়ায়নি। তারা কি ‘কম দামের ডলারে’ কাঁচামাল এনে উৎপাদন ব্যয় অভিন্ন রাখছে? ডিজেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহণ ব্যয় বাড়লে সেটা তাদেরও বেড়েছে একইভাবে। গ্যাসের বিল তাদেরও বেশি হারে দিতে হচ্ছে। আমদানিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কর-শুল্ক তাদের জন্য আলাদা করে কমেনি! এদিকে একই গ্রুপের ওষুধের দামে বড় তফাৎ আছে অনেক ক্ষেত্রে। ওষুধ বিষয়ে কিছু নির্ভরযোগ্য ‘সাইট’ রয়েছে, যেখানে গেলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামে তফাৎ দেখে অবাক হতে হয়। দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়ার এ সময়টায় মানুষ এসব সাইটে বেশি করে ঢুঁ মারছে। দোকানিরাও অনেক ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আলোকিত করছে ক্রেতাকে। তাদের তো স্বার্থ আছে। তারা দেখছে, ওষুধের বাড়তে থাকা দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে মানুষ। নিজেই তালিকা থেকে ‘কম জরুরি’ ওষুধ কাটছাঁট করছে। এ অবস্থায় ‘কমদামি’ ওষুধেরও খোঁজ করছে তারা। প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে-কমদামি ওষুধ কম কাজ করবে কিনা! বেশির ভাগ রোগী অবশ্য চোখ বন্ধ করে ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ কেনে। তারা প্রস্তুতকারক কোম্পানি বা দামের দিকেও তাকায় না। একশ্রেণির রোগী আবার বেছে বেছে ‘দামি’ ওষুধ খায়। কোনো কোনো কোম্পানির ওষুধের দাম সাধারণভাবে বেশি। এ কারণে তাদের একটা ‘ব্র্যান্ডিং’ হয়েছে। তবে ওষুধের মতো পণ্যের দামে এত তফাৎ থাকা স্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন তো উঠবে, আমরা ‘নিুমানের ওষুধ’ও বাজারে রাখতে চাই কিনা। উল্লেখযোগ্যভাবে কম দামের ওষুধ নিুমানের-এমন একটা ধারণা কিন্তু মানুষের মনে জাগতেই পারে। এমন ধারণা জারি থাকা সত্ত্বেও কাউকে ‘কমদামি’ ওষুধ কিনে খেতে হলে সেটা তো দুর্ভাগ্যজনক। ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ছে এবং এর মালিকপক্ষ যেভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে গিয়ে বক্তব্য পেশ করছে, তাতে মনে হয়, এবার প্রায় সব কোম্পানির ওষুধের দামই কিছু না কিছু বাড়বে। সরকার পোষাতে না পেরে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। তাকে তো কারও কাছ থেকে সম্মতিও নিতে হয় না। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ‘সম্মতি’ নিয়েই যা করার করবে। এ অবস্থায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির চাপে থাকলে তারা কিন্তু পারতো সরকারকে কর-শুল্ক ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানাতে। রমজান সামনে রেখে সম্প্রতি চারটি খাদ্যপণ্যে শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে। চাল-ডালের মতো না হলেও ওষুধও তো একটা জরুরি পণ্য। আর এর পেছনে ব্যয়টা মানুষকে করতে হয় পকেট থেকেই। সরকারি হাসপাতালে কম ফি’তে প্রেসক্রিপশন মিললেও ওষুধ মেলে না। স্বাস্থ্য পরীক্ষাও অনেক ক্ষেত্রে করাতে হয় বেসরকারি খাতে। সেখানেও খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডাক্তারের ফি বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এ অবস্থায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি রোধে সরকার এগিয়ে আসতে পারে কর-শুল্ক কমিয়ে। গ্যাস-বিদ্যুতের বিলেও বিশেষ ছাড় দিতে পারে। মার্চ থেকেই কিন্তু বিদ্যুতের দাম নতুন করে বাড়ানোর ঘোষণা এসে গেছে! অনেকে তো মনে করেন, কোনো কোনো পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবসা প্রায় করমুক্ত হওয়া উচিত। সেখান থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের চিন্তা না করাই ভালো। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে তারা ওষুধের কথা বলেন। এমনও বলেন-সব ওষুধের দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করা উচিত। কারণ এটা আর ১০টি পণ্য থেকে আলাদা। জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এর রয়েছে প্রত্যক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন প্রথিতযশা চিকিৎসককে এবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী করা হয়েছে। এ খাতের জমে থাকা সংকট মোকাবিলায় তিনি কতটা সফল হবেন, কে জানে। ওষুধশিল্প তার আওতাধীন না হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিশ্চয় চাইবেন, এর দাম বৃদ্ধির উত্তেজনা থামুক। ওষুধ কোম্পানিগুলো অবশ্য লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না। সেটা করছেও না তারা। বড় কিছু কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মুনাফার যে খবর পাওয়া যায়, তাতে কিন্তু মনে হয় না তারা বিপদে আছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানিও করছে তারা। রপ্তানিতে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বলেও মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তা করে দেখতে হবে, কীভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্তত ওষুধের দাম বৃদ্ধিটা রোধ করা যায়। অনেকে এমনও বলেন, ব্র্যান্ড নামে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা ডাক্তারদের পেছনে কোম্পানিগুলোর ব্যয় বন্ধ করা গেলেই আর নতুন করে দাম বাড়াতে হয় না। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ওষুধের বিজ্ঞাপন দিতে না পারাকে ইস্যু করে কোম্পানিগুলো এর ‘মার্কেটিং’ বাবদ যে বিচিত্র উপহারসামগ্রী কেনে, সেগুলোর দামও তো উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তার মানে, এ বাবদ বেড়েছে কোম্পানির ব্যয়। ডলারের বেড়ে যাওয়া দামের কথা বারবার বললেও এমনতরো ব্যয়ের কথা কিন্তু তারা কখনো বলে না। তবে এটা যে ওষুধের দামে ঢুকিয়ে রোগীর ওপর চালান করে দেওয়া হয়, সচেতন মানুষমাত্রই তা জানে। হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক