কুমিল্লা সিটি নির্বাচন আজ, কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার শঙ্কা


কুমিল্লা সিটি করপোরেশন উপনির্বাচনে মেয়র পদে ভোটগ্রহণ আজ। এ উপলক্ষ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল চলাচলে আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক কৌত‚হল রয়েছে। মেয়র পদে নতুন না পুরোনো মুখ আসছেন- তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা। নির্বাচন নিয়ে এমন কৌতূহল থাকলেও কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হার কেমন হবে- তার পক্ষে-বিপক্ষেও ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, উপনির্বাচনে শুধু মেয়র পদে ভোট হচ্ছে- এ কারণে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ কম। এছাড়া গত ২ দিন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে না যেতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সরকারি দলের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় ভোটারদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক রয়েছে। প্রতিপক্ষকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি এ নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। ভোটগ্রহণের সময় আকস্মিক সহিংসতা হতে পারে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এমন পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দৃশ্যমান করার সুপারিশ করেছেন ওই সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এমন পরিস্থিতে আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি ভোটকেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে। গতকাল ইভিএমসহ নির্বাচনি মালামাল ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচনি এলাকায় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসারের প্রায় তিন হাজার ৩০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি আছেন ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। শহরে প্রবেশ ও বের হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়েছে। এ নির্বাচনের ১০৫টি কেন্দ্রের সব ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে চারজন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রবার একাধিক বৈঠক হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে কিছু শঙ্কা আছে। ভোটারদের নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি ভোটারদের অনুরোধ জানাব, আপনারা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। আপনাদের নিরাপত্তা দেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংঘাতের শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে ৪-৫ মিনিটের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেন- সেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হুমকি দেওয়ার কিছু অভিযোগ পেয়েছি এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চারজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- ডা. তাহসীন বাহার সূচনা, সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু, মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ও নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম। বাস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডা. তাহসীন বাহার সূচনা ও হাতি প্রতীকের নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। আর সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু টেবিল ঘড়ি ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। তারা দুজনই বিএনপির রাজনীতি করতেন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা নির্বাচন করায় ২০২২ সালে তাদের দল বহিষ্কার করা হয়। এ সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মারা যাওয়ায় শুধু মেয়র পদে উপনির্বাচন হচ্ছে। মো. মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দুবার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২২ সালে অল্প ভোটের ব্যবধানে আরফানুল হক রিফাতের কাছে হেরে যান। তিনি এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অপরদিকে ডা. তাহসীন বাহার সূচনা এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন। মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ও নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম এর আগেও নির্বাচন করে হেরে গেছেন। স্থানীয়রা জানান, এবার মূলত ডা. তাহসীন বাহার সূচনা ও মো. মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে লড়াই হবে। দুজনই হেভিওয়েট প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে শুধুই মেয়র পদে ভোট হওয়ায় মানুষের আগ্রহ কিছুটা কম। আরও জানা গেছে, এ নির্বাচনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, ইভিএমে ভোট হওয়ায় গোপন কক্ষে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা অবস্থান করে নির্দিষ্ট একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে ভোটারদের বাধ্য করতে পারেন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১, ২, ৩, ৫, ৯, ১৫ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে এ ধরনের কার্যক্রমের প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ওই বৈঠকে কয়েকজন কাউন্সিলরের নামও উল্লেখ করা হয়। তারা আরও বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে হাইওয়ের অনেক সংযোগ সড়ক থাকায় বহিরাগতরা ভোটগ্রহণের সময়ে ভোটকেন্দ্রের আশপাশ এবং ভোটারদের যাতায়াতের পথে অবস্থান নিতে পারেন। শুধু তাই নয়, ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ডা. তাহসীন বাহার সূচনা ও মো. মনিরুল হক সাক্কুর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত হতে পারে। একাধিক প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তাদের বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে গতকাল। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত হলে সঙ্গে সঙ্গে কাছের আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের জানিয়ে সহযোগিতা চাইতে হবে। ভোটকেন্দ্রে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে তার বিরুদ্ধে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনে টহল বাড়ানোর সুবিধার্থে ১২ প্লাটুন বিজিবি ১৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে ১৫টি দলে টহল দেবে। প্রার্থীদের বক্তব্যে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার সুর: শুক্রবার চার মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তিনজন প্রার্থী ডা. তাহসীন বাহার সূচনার বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ করেন। বিশেষ করে ডা. তাহসীন বাহার সূচনার বাবা কুমিল্লা-৬ আসনের সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরুদ্ধে মূলত তাদের এ অভিযোগ। এই তিন প্রার্থী বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি থাকায় তারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তিনি বলেন, আমি বারবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছি। কুমিল্লা পৌরসভারও মেয়র ছিলাম। মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমার ওপর আস্থা আছে বলেই বারবার ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমি কেন ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখাব। যত বেশি ভোটার কেন্দ্রে যাবেন, আমার মেয়ে তত বেশি ভোট পাবে। যারা এসব কথা বলছেন, তারাই ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিচ্ছে। এক নজরে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের তথ্য: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১০৫টি ভোটকেন্দ্র ও ৬৪০টি ভোটকক্ষ আছে। ৭২টি প্রতিষ্ঠানে এসব ভোটকেন্দ্র অবস্থিত। নির্বাচনে ভোটার রয়েছেন দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। ভোটারদের মধ্যে এক লাখ ১৮ হাজার ১৮২ জন পুরুষ, এক লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ জন মহিলা ও ২ জন হিজড়া। নির্বাচনে ২০২৫ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০৫ জন প্রিসাইডিং, ৬৪০ জন সহকারী প্রিসাইডিং ও ১২৮০ জন পোলিং কর্মকর্তা। তারা শুক্রবার নির্বাচনি মালামাল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছেছেন। নির্বাচনের নিরাপত্তায় প্রায় তিন হাজার ৩০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পুলিশ ১৩৮৯ জন, বিজিবি ৩৬০ জন (১২ প্লাটুন), র্যাব ২১৬ জন (২৭টি টিম), ব্যাটলিয়ন আনসার ৫০ জন ও অঙ্গীভ‚ত আনসার ১২৬০ জন। ইভিএমে ভোট: ইসির কর্মকর্তারা জানান, সবকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হবে। ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় ইভিএমে ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিক তা প্রতিস্থাপনে অতিরিক্ত মেশিন রিজার্ভ রাখা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে যে সংখ্যক বুথ রয়েছে, তার দেড়গুণ ইভিএম পাঠানো হয়েছে। সবমিলিয়ে এ নির্বাচনে ৯৬০টি ইভিএম ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।