নির্বাচনে নজিরবিহীন ঘটনা


সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৪-২৫) নির্বাচন নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। তফশিল মতে, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সুষ্ঠুভাবে ভোট শেষ হয়। তবে শুক্রবার সকালে সমিতি মিলনায়তনে ভোট গণনা কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে হট্টগোল, বাদানুবাদ ও মারধরের মতো ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পাঁচ আইনজীবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের আদালতে নিয়ে রিমান্ড চাইলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই মামলায় বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তোপখানা রোড থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গণনার একপর্যায়ে সম্পাদক পদে এক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অবশ্য পরে তা আবার প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলাসহ একের পর এক নানা ঘটনাকে দুঃখজনক ও নজিরবিহীন বলে মনে করছেন সিনিয়র আইনজীবীরা। তারা সুপ্রিমকোর্ট বারের দীর্ঘ দিনের ইমেজকে সমুন্নত রাখার দাবি জানিয়েছেন। এর আগে ভোট গ্রহণ শেষে গত বৃহস্পতিবার রাতেই ভোট গণনা হবে কি না, এ নিয়ে কয়েকজন প্রার্থীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এর জের ধরে রাতেই এক দফা হট্টগোল হয়। তবে শুক্রবার ভোরে মারধর শুরু হলে ভোট গণনা আটকে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভোট গণনা ৪৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর শনিবার ফের শুরু হয়েছে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গণনা চলছিল। সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাকে দুঃখজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। তিনি শনিবার বলেন, এসব ঘটনা দুঃখজনক, কখনো কাম্য নয়। কষ্ট পাচ্ছি এসব কর্মকাণ্ড দেখে। পূর্বে এমন ঘটনা আমরা দেখিনি। এতে বারের ইমেজ ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তা আমি আগে কখনো দেখিনি, যা অপ্রত্যাশিত। পুলিশ আইনজীবীকে লাঠিপেটা করবে, গ্রেফতার করবে এটা কি হতে পারে। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, আইনজীবীদের একটা মর্যাদা আছে। এটা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নষ্ট করে, তা দুঃখজনক ছাড়া আর কী হতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, বর্তমানে যেসব ঘটনা বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র ঘটেছে তা সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু নির্বাচনে সভাপতি হওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে। তিনি শপথ নেওয়ার পর আর বসতে পারলেন না। এটা সংকট তৈরি হয়। বর্তমানে যা হচ্ছে তা আগে ছিল না, এটা খুবই লজ্জার, দুঃখজনক ও নজিরবিহীন। এবারের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয় গত বুধ ও বৃহস্পতিবার। ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়। তবে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার ভোরে সমিতি মিলনায়তনে হট্টগোল, বাদানুবাদ ও মারধরের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে জানান বেশ কয়েকজন আইনজীবী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতেই ভোট গণনা করা হবে কি না, এ নিয়েও মতবিরোধ দেখা দেয়। এর জের ধরে হট্টগোল ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়েরের বক্তব্যের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, সমিতির মিলনায়তনে তিনি বলেছেন, ‘শুধুমাত্র নাহিদ সুলতানা (যুথী) সম্পাদক প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। তাই তাকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো।’ প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ শেষে সমিতির মিলনায়তনে ভোট বাছাই প্রক্রিয়া শেষ হয় রাত ২টার পর। এর আগে কোনো কোনো প্রার্থী ব্যালটের সঙ্গে মুড়ির মিল না থাকার কথা উল্লেখ করে আপত্তি তোলেন। পরে ভোট গণনা শুরু করা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এর আগে থেকে অর্থাৎ সন্ধ্যার পরপরই সমিতি ভবনের বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের অবস্থান করতে দেখা যায়। সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানা ও বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন রাতেই ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। তবে এত রাতে প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকার কথা উল্লেখ করে সাদা প্যানেলের সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হকসহ কয়েকজন শুক্রবার দিনের বেলা ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। উপস্থিত একাধিক আইনজীবী জানান, বাছাই প্রক্রিয়ার পর একপর্যায়ে উপকমিটির আহ্বায়কের কাছ থেকে একজন প্রার্থীর সমর্থক মাইক্রোফোন কেড়ে নেন। পরে কমিটির অপর এক সদস্য তা আহ্বায়কের কাছে ফিরিয়ে দেন। একপর্যায়ে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ব্যালটগুলো সিলগালা করে রাখা হবে। শুক্রবার দুপুরের পর ভোট গণনা হবে। তবে শুক্রবার ভোট গণনা নিয়ে আপত্তি জানান একাধিক প্রার্থী। শুক্রবার ভোরের দিকে উপস্থিত এক আইনজীবী মিলনায়তন থেকে বের হওয়ার ফটক খুলে দিতে গেলে তাতে আপত্তি জানান উপকমিটির এক সদস্য। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তি সমিতি মিলনায়তনে ঢুকে পড়েন। তারা নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এসআর সিদ্দিকী সাইফের ওপর চড়াও হন। এ সময় মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে আরও কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মারধরের ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এসআর সিদ্দিকী জানান, তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন। এ জন্য একজন প্রার্থীর সমর্থককে দায়ী করেন তিনি। চাপ সৃষ্টি করে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয় : নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়ের শনিবার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভোট গণনার আগেই দুঃখজনকভাবে বহিরাগত মস্তান শ্রেণি কর্তৃক আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয়। যদিও তা অর্থহীন ঘোষণা, তবুও কূটতর্ক নিরসনের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তা ‘ইগনোর’ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ভোট গণনা করেই ফলাফল ঘোষণা করা হবে।’ পাঁচ আইনজীবী রিমান্ডে : এদিকে শুক্রবার রাতে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনায় শাহবাগ থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সাইফুর রহমান সিদ্দিকী সাইফ (এসআর সিদ্দিকী সাইফ)। মামলায় ২০ জন আসামির মধ্যে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসও রয়েছেন। এ মামলায় পাঁচ আইনজীবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার গ্রেফতার পাঁচজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত। প্রত্যেক আসামিকে তিন দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়। রিমান্ডপ্রাপ্ত পাঁচজন হলেন সুপ্রিমকোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী বশির আহমেদ, আইনজীবী ওসমান চৌধুরী, হাসানুজ্জামান, তরিকুল ইসলাম ও এনামুল হক। পুলিশ ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গ্রেফতারকৃতদের শনিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। অপরদিকে পাঁচ আসামির পক্ষে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন বাতিল করে জামিন চাওয়া হয়। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত পাঁচজনেরই তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে একই মামলায় বিএনপি-সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসকে (কাজল) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে রাজধানীর তোপখানা রোড থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সমিতির নির্বাচনের তফশিল অনুসারে, ৬ ও ৭ মার্চ ভোট গ্রহণ হয়। নির্বাচনে ৭৮৮৩ জন ভোটারের মধ্যে ৫৩১৯ জন ভোট দেন। সভাপতি, সহসভাপতি (দুটি), সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদক (দুটি), সদস্য ৭টিসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এ নির্বাচন হয়ে থাকে। ১৪টি পদের বিপরীতে এবার নির্বাচনে ৩৩ জন প্রার্থী হন।