জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা


ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ সোমালিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যে জাহাজটি জলদস্যু নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পৌঁছতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে- নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জাহাজটি নোঙ্গর করার পর জলদস্যুরা মুক্তিপণের দাবিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর এমন যোগাযোগের অপেক্ষায় রয়েছে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ এসআর শিপিং লাইন্স লিমিটেড। এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের বিপদমুক্ত করা আমাদের লক্ষ্য। তাদের উদ্ধারে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। জিম্মি নাবিকদের কয়েকজন তাদের স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা সবাই সুস্থ আছেন। জাহাজের ছাদে ও কেবিনে তাদের রাখা হয়েছে। খাবার-দাবারে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। পবিত্র রমজানে তারা নামাজ-রোজা করতে পারছেন না। তবে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়নি। জিম্মি নাবিকরা তাদের উদ্ধারে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ ও সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। উদ্ধারকাজে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার আকুতি জানিয়েছেন তারা। মালিকপক্ষও জিম্মি নাবিকদের স্বজনদের অফিসে ডেকে নিয়ে আশ্বস্ত করেছেন। নাবিকদের উদ্ধারে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। জলদস্যুদের সঙ্গে তারা যোগাযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে কয়লাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। দক্ষিণ আফ্রিকার মুজাম্বিকের মাফুতু বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি শারজার হামারিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সশস্ত্র সোমালি জলদস্যুরা হাই স্পিডবোটে এসে জাহাজটিতে উঠে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ক্যাপ্টেনসহ ২৩ নাবিককে জিম্মি করে। স্বজনদের সঙ্গে নাবিকরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার পর সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে একাধিক ফোন থাকায় কৌশলে স্বজনদের সঙ্গে কেউ কেউ বুধবারও মেসেজে যোগাযোগ করেছেন। তাদের মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা যাচ্ছে। জাহাজটিতে প্রায় দুই মাসের খাবার রয়েছে। তাই খুব শিগগিরই খাবারের কোনো সংকট হবে না। এছাড়া পর্যাপ্ত জ্বালানিও রয়েছে। এসআর শিপিং লিমিটেডের পক্ষ থেকে জানানো হয়- জলদস্যুদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়নি। তবে মোবাইল ফোনে বুধবার বিকাল পর্যন্ত নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সর্বশেষ নাবিকরা জানান, জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা নিরাপদে রয়েছেন। নাবিকদের মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মেরিটাইম সংস্থার সঙ্গে জাহাজটির মালিকপক্ষ যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যায় এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা। বৃহস্পতিবার দুপুর বা বিকাল নাগাদ এটি সোমালিয়া পৌঁছার কথা। এরপর যোগাযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ পর্র্যন্ত দস্যুদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়নি। কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মেহেরুল বলেন, ‘এটা অনেক পরের বিষয়। আগে তাদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হতে হবে। এরপরই আসতে পারে মুক্তিপণের বিষয়। তিনি জানান, জাহাজের ক্যাপ্টেন সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অফিশিয়াল মেসেজ পাঠিয়েছেন। নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। নাবিকরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের দুলাভাই ইউসিবিএল ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আজিজুল হক বলেন, আতিকুল্লাহ সর্বশেষ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেছেন। তার আরেক শ্যালক আসিফের হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মেসেজে নিজেদের নিরাপদে থাকার কথা বলেছেন। তবে খাওয়া-দাওয়া ও আহার-নিদ্রায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছে। সবাইকে জাহাজের ছাদে কর্ডন করে রেখেছে জলদস্যুরা। তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়নি। আজিজুল হক জানান, মালিকপক্ষ তাদের কোনো ধরনের চিন্তা না করতে বলেছেন। তাদের উদ্ধারে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সর্বাÍক প্রচেষ্টা চালানো হবে। জিম্মি নাবিক নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, মঙ্গলবার বিকালে কল দিয়ে আমার স্বামী বলেন, তাদের জাহাজে জলদস্যুরা আক্রমণ করেছে। তাদের অবস্থা অনেক খারাপ। তাদের অফিসে কল দিয়ে বিষয়টি জানাতে বলেছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের অফিসে জানিয়েছি। জাহাজ ও নাবিকদের বিপদমুক্ত করাই লক্ষ্য- পররাষ্ট্রমন্ত্রী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকদের বিপদমুক্ত করা। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কুয়ালালামপুরে পাইরেসি রিপোর্টিং সেন্টার, নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার, যুক্তরাজ্য মারিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকেএমটিও) এবং এশিয়ায় দস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি প্রতিরোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় সিঙ্গাপুরে অবস্থিত দপ্তরকে খবর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই অঞ্চলে চলাচলরত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের জাহাজগুলোকেও বাংলাদেশের জাহাজটির অবস্থা রিপোর্ট করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সিনেট ভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। নাবিকদের ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ সভায় অনানুষ্ঠানিক আলোচিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও উদ্বিগ্ন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জলদস্যুদের সঙ্গে কোনো ‘ফরমাল’ যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি, অন্য পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এটি নিয়ে তৎপর রয়েছে। জিম্মি নাবিকদের সুস্থ ফেরত আনতে সরকার বদ্ধপরিকর- নৌপ্রতিমন্ত্রী : সোমালিয়ার জলসীমায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের সুস্থ ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, এ জাহাজের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। নাবিক ও জাহাজ উদ্ধার করার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চেয়েছি। আমরা প্রথম যে বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা হলো- নাবিকদের নিরাপদ রাখা। জীবন রক্ষা করে তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসাই আমাদের প্রথম কাজ। নাবিকরা নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। নাবিকদের পরিবার উদ্বিগ্ন দিন কাটাচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিবারগুলোর দিন কীভাবে যাচ্ছে সেটা আমরা অনুভব করছি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কিছু সংগঠন আছে। জলদস্যুদের সঙ্গে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ আছে। এর আগে অলিভিয়া বন্দরে আমাদের জাহাজ আটকে পড়ার পর আমরা কিছু কিছু জায়গায় সহযোগিতা নিয়ে সফলতা পেয়েছি। যে কোনো মূল্যে সুস্থ অবস্থায় আমাদের নাবিকদের ফেরত আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।