৫৮ বছরেও শুরু হয়নি মূল কাজ


সরকার নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর (ইউডিডি) প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরেও মূল কাজই শুরু করতে পারেনি। দীর্ঘদিনেও সংস্থাটির প্রধান কাজ জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন হয়নি। এতে দেশে অপরিকল্পিত ও ভুল উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে বছরে গচ্চা যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। ২০১৭ সালে জাতীয় ভৌত পরিকল্পনার উদ্যোগ নিয়ে তা অনুমোদন করাতে পারেনি। ওই বছরে নগর উন্নয়ন আইন প্রণয়ন করে অনুমোদনের জন্য পাঠালেও তা অদ্যাবধি ঝুলে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যেক দেশেরই জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা থাকে। এটি ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জল ও স্থলের সব ভূমি ব্যবহারে এই নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। এতে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ঘটে। কৃষিভূমি, বনভূমি, জলভূমি, পাহাড় সুরক্ষা পায়। মানুষের চাহিদার আলোকে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এতে ভুল উন্নয়ন অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করে অপচয় রোধ করা যায়। জানা গেছে, বাংলাদেশ অঞ্চলকে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলতে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন সরকার নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর (ইউডিডি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার প্রধান কাজ জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এটি দেশের ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংবিধানস্বরূপ। অর্থাৎ প্রতি ইঞ্চি জমির কি ব্যবহার হবে সে ব্যাপারে নির্দেশনা থাকে ওই জাতীয় পরিকল্পনায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় বিল্ডিং কোড যে কোনো দেশের ভবন নির্মাণের মূল দলিল। এই কোডের নির্দেশনা অনুসরণ ছাড়া ভবন নির্মাণ অবৈধ। সরকার ওই কোড অনুসরণ করে দেশের টেকসই ভবন উন্নয়ন নিশ্চিতে কাজ করছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভূমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভৌত পরিকল্পনাকে দলিল হিসাবে ধরে ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে বাংলাদেশে ওই দলিল তৈরি না হওয়ায় সরকার ভূমি ব্যবহার বা প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করতে পারছে না। গোড়ার এই গলদের কারণে যথেচ্ছভাবে কৃষিজমি, জলাভূমি, পাহাড় তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ঘটছে। বছরে দেশের ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি অপরিকল্পিত আবাসন ও শিল্পায়নের ফলে কমে যাচ্ছে। সরকার এসব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও সহায়ক কোনো আইন বা নীতিমালা সরকারের হাতে নেই। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে সরকার আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউডিডির ওয়েবসাইট ভিজিট করে দেখা যায়, রূপকল্প ও অভিলক্ষ্য একটি সারি রয়েছে। সেখানে রূপকল্প বা মিশন নিয়ে লেখা আছে; পরিকল্পিত বাংলাদেশ গঠন করা। আর ভিশন বা অভিলক্ষ্যে রয়েছে, দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনাপূর্বক সমন্বিত নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। আর ইউডিডি’র কার্যক্রমের সারিতে লেখা রয়েছে, ১৯৬৫ সালের ৫ জুলাই এক সরকারি আদেশের মাধ্যমে ইউডিডি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মার্শাল ল’ কমিটির রিপোর্ট ১৯৮৩ অনুসারে এই সংস্থার মূল কাজ-জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও স্থানীয় পর্যায়ের কাঠামোগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। তবে দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী শহর অর্থাৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এলাকার মাষ্টারপ্ল্যান বা স্থানীয় পরিকল্পনা ওই কর্তৃপক্ষ করবে। পরিকল্পনার ৫০ বছর শিরোনামে ২০২২ সালের জুনে একটি প্রকাশনা বের করে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। এই প্রকাশনার সারসংক্ষেপে বলা হয়, ইউডিডি ৯ হাজার ৮৮১ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। যেটা মোট বাংলাদেশের তুলনায় ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। ইউডিডি সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় দুই দশক ইউডিডি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করত। সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা এই সংস্থার নেতৃত্বে থাকতেন। ইউডিডি পরিচালকের স্বাক্ষরই আইনগত মর্যাদা পেত। তবে ধীরে ধীরে ইউডিডির গুরুত্ব কমেছে। এর বড় কারণ রাজনীতিবিদরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো উন্নয়ন কাজ করতে চান। নিজের বাড়ির সামনে সড়ক বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চান। পরিকল্পনা করে করলে হয়তো ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। তারা জানান, সমীক্ষা ও পরিকল্পনা করে কাজ করলে সব জায়গায় বড় প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ থাকে না। আর সব কাজ দৃশ্যমানও হয় না। অনেক রাজনীতিবিদের দৃশ্যমান ও বড় প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। পরিকল্পনা বিষয়টি অনেকটা আইনি ও অদৃশ্যমান কাজ। এজন্য তাদের আগ্রহও কম দেখা যায়। এজন্য প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী রূপ নিতে পারল না। ইউডিডির কয়েকজন নগরপরিকল্পনাবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতদিন ইউডিডির নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করে রেখেছেন। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নকারী সংস্থা হলেও অপরিকল্পনাবিদদের প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন তারা। নিজেদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বজায় রাখতে লড়েছেন। কয়েকবার জনবল কাঠামো সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে অপরিকল্পনাবিদদের সংখ্যা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদায়নের ঘটনাও প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ইউডিডিতে এখনো কয়েকজন দেশের সেরা পরিকল্পনাবিদ রয়েছে। কিন্তু তাদেরকে কৌশলে প্রেষণে পাঠানো হয়। আবার কাউকে দমিয়ে রাখা হয়। তাদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে না। প্রধান কারণ অপরিকল্পনাবিদরা প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সরকারের উর্ধ্বতন দায়িত্বপ্রাপ্তরা ইউডিডির সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন। জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, জাতীয় ভৌত পরিকল্পনার অভাবে খাপছাড়া উন্নয়ন হচ্ছে। ভৌত পরিকল্পনা না থাকায় পরিকল্পনা কমিশনও প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই করতে পারছে না। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের অনুমোদন ঘটছে। এতে বছের শত শত কোটি টাকার অপচয় ঘটছে। ২০১৭ সালে ইউডিডি পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় ভৌত অবকাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব করে। ভৌত অবকাঠামো বিভাগে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়। তবে ইউডিডির সক্ষমতা বিবেচনায় এটিকে এলজিইডি ও ইউডিডিকে যৌথভাবে করার বিষয়ে আলোচনা হয়। নানা কারণে বিষয়টি আড়ালে পড়ে যায়। পরে তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তিনি জানান, বাংলাদেশ ছোট্ট দেশ হলেও এখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমি ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার না হওয়ায় বছরে এক শতাংশ কৃষি ভূমি অকৃষি খাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। দেশ বাঁচাতে সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। কর্তৃপক্ষের অভিমত, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মো. নবীরুল ইসলাম। সোমবার এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ইউডিডি কেন তার কাজগুলো করতে পারছে না, তা খতিয়ে দেখা হবে। আমি এই মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর ইউডিডির বিষয়ে আলোচনা শুনেছি। বর্তমান মন্ত্রী মহোদয় শহর এলাকার পাশাপাশি পুরো দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এটা বর্তমান সরকারও চায়। এজন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইউডিডিকে নিয়ে আমরা বসব। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে উদ্যোগ নেব। যাতে করে ইউডিডি পরিকল্পিত বাংলাদেশ গঠনে তাদের কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারে।