উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চিত্রটা যেন আরও একবার বেরিয়ে এলো। বর্তমানে দলীয় শৃঙ্খলা যে আগের মতো নেই, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গত জাতীয় নির্বাচনের সময়ও এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গুরুত্বের দিক থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই উপজেলা নির্বাচনকে ধরা হয়ে থাকে। এ কথা বিবেচনা করে সরকারের মন্ত্রী ও এমপিরা দলের সভাপতির কড়া নির্দেশ উপেক্ষা করেই গণহারে তাদের আত্মীয়স্বজনদের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিগত নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে একটা ধারণা চালু হয়েছে, দলের পরিচয়ে নির্বাচন করা মানে নির্বাচনে জয়লাভ করা। গত প্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসনের বিভাগগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা আমরা দেখে এসেছি, সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, নেতাকর্মীরা মনে করতেই পারেন, দলীয় প্রার্থী হতে পারলেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া নিশ্চিত। বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা এখন রাজনীতিতে তাদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতদিনের উপার্জিত অর্থ ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে স্ত্রী, সন্তান, ভাই এবং পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতার স্বাদ উপভোগের পথ করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ফলে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আবারও পিছিয়ে পড়বেন। তাতে দলের ভেতরে অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পাবে। দলের জন্য এটি মোটেও ভালো নয়। দেরি করে হলেও আওয়ামী লীগের উঁচু মহল যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাই বা মন্দ কীসের!
এবারের উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ না করে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দাবির মুখেই এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য হলো, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি এ নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা। জাতীয় নির্বাচনের পরপরই সরকার আর বদনাম নিতে রাজি নয়। দলের প্রভাবশালীরা যাতে প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে না পারেন, এজন্য সরকার স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া জেলা-উপজেলার প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাÍক সহযোগিতা করতে বলেছে। আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানালেন, বিএনপি এবারের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। অতএব জাতীয় নির্বাচনের মতোই এবারের উপজেলা নির্বাচনও আমাদের-আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এজন্য কেন্দ্র থেকে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা হিসাবি হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী-এমপিরা সে নির্দেশ মান্য করেননি। তারা সন্তান, ভাই, শ্যালক, পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং নিজস্ব লোককে (?) নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মনে করছেন, এভাবে মন্ত্রী-এমপিরা দলীয় নির্দেশ অমান্য করে যদি প্রভাব বিস্তার করেন, তাহলে নিজেদের মধ্যেই সংঘাতের সৃষ্টি হবে। ফলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা আর সম্ভব হবে না; যা দেশ-বিদেশে সমালোচনার জন্ম দেবে।
উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের পরিবারের সদস্যদের নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্র থেকে সবার উদ্দেশে কড়া নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যদি কেউ ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কেউ ব্যর্থ হলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। ভবিষ্যতে দলীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। এ নির্দেশের পর মন্ত্রী ও এমপির কিছু কিছু আত্মীয় ও নিজস্ব ব্যক্তির নাম প্রত্যাহার করা হলেও অনেকেই প্রার্থিতা বহাল রেখেছেন। তবে নাম প্রত্যাহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় হলে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না, এ বিষয়টি কতটা যৌক্তিক? এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান বেশ স্পষ্ট। কোনো অবস্থাতেই তারা উপজেলা নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছেন না। এমনিতেই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে এমন কিছু দল ছাড়া অধিকাংশ বিরোধীদল এ সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় না। এ নিয়ে অনেক বদনামও আছে। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে এ বদনাম ঘোচাতে। সরকার চাচ্ছে এমন একটি নির্বাচন করতে, যাতে দেশের মানুষের ভোটের প্রতি আস্থা ফিরে আসে। তারা চাচ্ছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থীরা যেন জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছেন। মন্ত্রী বা এমপির পরিবারের সদস্য হলেই উপজেলা নির্বাচন করা যাবে না, এ সিদ্ধান্তটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আপনি যে কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন; কিন্তু আপনার যুক্তি জনগণ কী চোখে দেখছে? দেশের ভোটাররা কী চোখে দেখছে? আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্তে মানুষ খুশি হয়েছে। দলের তৃণমূলের কর্মীরা তাদের মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। একটা দলে আমি এমপি, আমি মন্ত্রী, আবার আমারই ভাই, সন্তান যদি সব পদ নিয়ে নেয়, তাহলে তৃণমূলের কর্মীরা কী করবে? তাদের উঁচু পদে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই? সে সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এ সিদ্ধান্ত।’
নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের আত্মীয়রা কী করতে পারেন তার খাঁটি উদাহরণ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব। লুৎফুল হাবীব হলেন নাটোরের সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার লোকজন দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ ও মারধর করেছেন। ১৭ এপ্রিল বিকালে নাটোর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের ভেতর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করতে করতে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সন্ধ্যার কিছু আগে মুমূর্ষু অবস্থায় তার গ্রামের বাড়ির সামনে ফেলে রেখে চলে যায় অপহরণকারীরা। এ ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা আগে দেলোয়ার হোসেনের ভাইসহ আওয়ামী লীগের আরও এক নেতাকে একই এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। অপহরণকারী সবাই লুৎফুল হাবীবের লোক এবং অনেকেই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অপহরণকারীদের দলে লুৎফুল হাবীবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ও গাড়ির চালকও ছিলেন। পুলিশ তাদের অনেককে গ্রেফতার করলেও লুৎফুল হাবীব রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে, আটককৃত ব্যক্তিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে লুৎফুল হাবীবের পক্ষেই এ অপহরণ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালকের এ অপকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন ও ক্ষমা চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত লুৎফুল হাবীব দলের চাপে তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতানেত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী এ ঘটনায় লুৎফুল হাবীবের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। অনেকেই মনে করছেন, লুৎফুল হাবীব প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
এবারের উপজেলা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল। এগুলো হলো, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। দলের পক্ষ থেকে কাউকে মনোনয়ন না দেওয়া। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের দলীয় পরিচয় ব্যবহার না করা এবং পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত মানতে কেউ রাজি নন। অনেকেই মনে করছেন, অতীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো অপরাধ করলেও কঠোর শাস্তি না দেওয়ায় এখন দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার মতো সাহস দেখাচ্ছেন অনেকে। এলাকায় এসব মন্ত্রী-এমপির প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ও স্থানীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের আগ্রাসী মনোভাব, দলের ভালো উদ্দেশ্যকে ভূলুণ্ঠিত করছে। তাতে শুধু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গই হচ্ছে না, কিছু কিছু ব্যক্তির ঔদ্ধত্যও প্রকাশ পাচ্ছে। এর লাগাম যদি এখনই টেনে না ধরা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দলীয় শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় মাঠ পর্যায়ে এখন থেকেই আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ উপজেলা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটবে। মাঠ পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন কমিশনও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করছে। এ পরিবেশ দিন দিন আরও ভয়ংকর রূপ লাভ করবে। এ পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও চাপ বৃদ্ধি করছে। তারা ইতোমধ্যে অনুরোধ করেছেন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকালে ওপর মহলের হস্তক্ষেপ বন্ধের যেন ব্যবস্থা করা হয়। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। একটি কথা ভেবে অবাক হই, বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবেশ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কিছুদিন আগেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য সরকারের তরফ থেকে বিরোধীদলকেই দায়ী করা হতো। আর এখন, সরকারি দলের নেতারা নিজ দলের মন্ত্রী-এমপি দ্বারা যাতে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট না হয়, সে আশঙ্কাতেই ভুগছেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা যতই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার আশা পোষণ করুন না কেন, এ পরিস্থিতি যদি এখন থেকেই সামাল দিতে না পারেন, তাহলে এদেশের জনগণ হয়তো আরও একটি গতানুগতিক বিশৃঙ্খল স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রত্যক্ষ করবে।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।