বিচারকাজ শেষ হয়নি একটি জঙ্গি হামলারও


অপারেশন থান্ডার বোল্ট থেকে অপারেশন কুলাউড়া। ২০১৬ থেকে ২০২৪-এই আট বছরে অনেক জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এগুলোর মধ্যে আছে থান্ডার বোল্ট, শোলাকিয়া, টোয়াইলাইট, স্ট্রাইক আউট, সানডেবিল, স্টর্ম-২৬, হিট স্টর্ম, রূপনগর, আজিমপুর, স্পেট এইট, রিপল-২৪, অ্যাসাল্ট-১৬, হিট ব্যাক, ম্যাক্সিমাস, ঈগল হান্ট, সাবটেইল স্পিলিট-২, টেপিড পাঞ্চ, আগস্ট বাইট, গর্ডিয়ান নট প্রভৃতি। অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গত আট বছরে ২৬টি আস্তানা ঘিরে বড় অভিযান চালিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এগুলোর মধ্যে ১০টি মামলার তদন্ত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এই বিশেষায়িত ইউনিট। বাকিগুলোর তদন্তভার দেওয়া হয় অন্যান্য সংস্থাকে। সিটিটিসির তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ছয়টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দুটিতে দেওয়া হয়েছে এফআরটি (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু)। দুটি মামলা এখনো তদন্তাধীন। বিচারকাজ শেষ হয়নি একটি জঙ্গি হামলারও। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। অপারেশন্স থান্ডার বোল্ট : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জঙ্গিবিরোধী চালানো অভিযানগুলোর সবচেয়ে আলোচিত ছিল অপারেশন্স থান্ডার বোল্ট। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঘটেছিল দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম ওই জঙ্গি হামলা। এতে মারা যান দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিক, দুই পুলিশ সদস্য এবং পাঁচ জঙ্গি। বহুল আলোচিত এই ঘটনায় ২০১৮ সালের ১ জুলাই আটজনকে আসামি করে সিটিটিসি ইউনিটের তৎকালীন পরিদর্শক হুমায়ুন কবির আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মঙ্গলবার তিনি জানান, অপারেশন থান্ডার বোল্টের ঘটনার সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। চার্জশিটভুক্ত আট আসামির মধ্যে সাতজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে আদালত রায় দিয়েছেন। এখন এটি আপিল বিভাগে আছে। অপারেশন স্টর্ম ২৬ : আলোচিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলোর মধ্যে অপারেশন স্টর্ম-২৬ অন্যতম। রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই অভিযানে নয়জন নিহত হয়। তাজ মঞ্জিল নামের ছয়তলা ওই ভবনটি স্থানীয়দের কাছে ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামে পরিচিত ছিল। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর পুলিশ পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম ১০ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে চার্জশিট দাখিলকারী কর্মকর্তা কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে সিটিটিসির উপকমিশনার জাহিদুল হক তালুকদার বলেন, মামলাটি এখন বিচারিক প্রক্রিয়ায় আছে। অপারেশন রূপনগর : ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর রাজধানীর রূপনগরের একটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চালায় সিটিটিসি। অভিযানে নিহত হন সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম। ওই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন রূপনগর। ওই ঘটনায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর আদালতে এফআরটি দেন তদন্তকর্তা হুমায়ুন কবির। তিনি মঙ্গলবার বলেন, যাকে গ্রেফতারের জন্য আমরা ওই অভিযানটি চালিয়েছিলাম, তিনি অভিযানে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন সেখানে অন্য কোনো জঙ্গি ছিল না। তাই এ সংক্রান্ত মামলাটি এফআরটি দেওয়া হয়েছে। অপারেশন আজিমপুর : রাজধানীর আজিমপুরে একটি বাড়ি ঘিরে রেখে সিটিটিসি অভিযান চালায় ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ওই অভিযানে তৎকালীন শীর্ষ জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরী নিহত হন। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সহকারী পুলিশ কমিশনার আহসানুল হক ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এ বিষয়ে সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, মামলাটির বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। অপারেশন রিপল-২৪ : রাজধানীর দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় ‘সূর্য ভিলা’ নামের একটি বাড়ি ঘিরে রেখে জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানো হয় ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর। অপারেশন রিপল-২৪ নামে ১৪ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর এই অভিযানে শিশুকন্যাসহ দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে। গ্রেনেড বিস্ফোরণে নারীসহ দুই জঙ্গি নিহত ও এক শিশু আহত হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় চারজনকে আসামি করে সিটিটিসি পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। মামলাটির বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি বলে সিটিটিসি সূত্র জানিয়েছে। অপারেশন মোহাম্মদপুর : ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে জঙ্গিনেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও তার সঙ্গী জঙ্গি সাদ্দাম নিহত হয়। পুলিশ জানায়, গুলশান হামলার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিল মারজান। কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া ছবি থেকে হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের অপারেশনাল চিফ মারজানের নাম-পরিচয় জানা যায়। এ বিষয়ে সিটিটিসির উপকমিশনার জাহিদুল হক তালুকদার বলেন, অপারেশন মোহাম্মদপুরের ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল নজরুল ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আদালতে এফআরটি (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু) দাখিল করেছেন। তিনি বলেন, ওই অপারেশনে বড় মাপের দুজন জঙ্গি নিহত হয়েছেন। আরেকজন পালিয়ে গেলেও তদন্তে তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এ কারণে মামলাটিতে এফআরটি দাখিল করা হয়েছে। অপারেশন আগস্ট বাইট : রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট পুলিশি অভিযানে নিহত হয় জঙ্গি সাইফুল ইসলাম। প্রায় ৪ ঘণ্টা অপারেশনের পর সফল হয় ‘আগস্ট বাইট’ নামের এই অভিযানটি। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিটিটিসির তৎকালীন পরিদর্শক রাজু আহম্মেদ। অপারেশন এলিগ্যান্ট বাইট : ২০২০ সালের ২৪ জুলাই রাজধানীর পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের পাশে এবং ৩১ জুলাই নওগাঁর সাপাহারে একটি মন্দিরে বোমা হামলা করেছিল জঙ্গিরা। পরে ওই জঙ্গিরা সিলেটে গিয়ে আস্তানা তৈরি করে। ২০২০ সালের আগস্টে সিটিটিসি অভিযান চালায় সিলেটে। অপারেশন এলিগ্যান্ট বাইট নামের ওই অভিযানে সিলেট নগরীর মিরাবাজার, টুকের বাজার ও দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, তদন্ত শেষে ১০ জনকে আসামি করে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বিশেষ অভিযান : সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ১টি পিস্তল ও ৪টি গুলিসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশকে সে জানায়, তার কাছে থাকা অস্ত্র ছাড়া আরও বিপুলসংখ্যক অস্ত্র মজুত আছে। এ অস্ত্রগুলো হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের গহিনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পরদিন আসামিকে সঙ্গে নিয়ে সিটিটিসি ইউনিট সাতছড়িতে বিশেষ অভিযান চালায়। অভিযানকালে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে দুটি স্থানে মাটি খুঁড়ে ১৫টি গ্রেনেড, ২৫টি বোস্টার ও ৫১০টি গুলি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় একজনকে আসামি করে ২০২২ সালের ১৭ মার্চ আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। অপারেশন কুলাউড়া : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার দুর্গম কালাপাহাড় এলাকায় জঙ্গি আস্তানা ঘিরে গত বছরের ১১ এবং ১২ আগস্ট অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। সিটিটিসি জানিয়েছে, সেখান থেকে আটককৃতরা জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ সদস্য। এ সংক্রান্ত মামলা দুটি এখনো তদন্তাধীন বলে সিটিটিসি জানিয়েছে। সিটিটিসি প্রধানের বক্তব্য : ডিএমপির সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর আমরা জঙ্গিদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরে আমাদের ক্রমাগত অভিযানে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অভিযানে অনেক জঙ্গি নিহত হয়েছে। অনেককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছি। জঙ্গিবাদ এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাদের ওপর সব সময় আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে।