স্বপদে ফিরতে অফিস নথিতে অনুপস্থিত


ঢাকা জেলার রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলাম। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এ সরকারি কর্মকর্তা এখন কারাবন্দি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ৩০ এপ্রিল মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানিকালে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। জামিন আবেদন নাকচ করে বিচারক তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে ওই দিন থেকেই তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, এক সপ্তাহ কারান্তরীণ থাকার বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্তারা জেনেও না জানার ভান করছেন। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি। নেওয়া হয়নি ন্যূনতম বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা। উলটো কারাগারে থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে অফিস নথিতে তাকে ‘অনুপস্থিত’ দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরে চলছে নানা গুঞ্জন। অভিযোগ আছে-প্রভাবশালী মহলের ইশারায় তাকে এই জালিয়াতির সুযোগ করে দিয়েছেন অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা। এ সুযোগে অতি দ্রুততার সঙ্গে জামিনে বেরিয়ে স্বপদে ফিরতে কোটি টাকার মিশনে মরিয়া তৎপরতা চালাচ্ছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। আর এ কাজে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর আইনজীবী ‘বান্ধবী’। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমত হচ্ছে-দুর্নীতির মামলায় একজন কর্মকর্তার কারাবন্দি হওয়ার বিষয় কর্তৃপক্ষ জানবে না এটা অসম্ভব। এটা হতেই পারে না। পরস্পর যোগসাজশে ছুটির নামে কারাবন্দি থাকার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার বিষয়টি একদিকে প্রতারণামূলক জালিয়াতি। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে দুর্নীতি সহায়ক সিন্ডিকেট আছে সেটাই প্রমাণ করে। সেটা না হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিভাগীয় পদক্ষেপ থেকে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহায়তা করার মতো সব ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করত। তা না হওয়ায় প্রকারান্তরে তাকে সুরক্ষা দেওয়ার সব ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় তারা দুর্নীতির সহায়ক শুধু নন, অভিযুক্ত ব্যক্তির সহযোগী এবং তার মাধ্যমে তাদের একাংশ লাভবান হয়েছে।’ এসব বিষয় বক্তব্য জানতে সোম ও মঙ্গলবার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও মহাপরিদর্শক নিবন্ধন (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে কুলসুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মঙ্গলবার সকালে বক্তব্য চেয়ে তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি। জানা গেছে, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের মিথ্যা তথ্য দাখিল এবং জ্ঞাতআয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১ কোটি ২১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪৯ টাকার সম্পদ ভোগদখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটির তদন্ত শেষে গত ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। দুদকের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ৩০ এপ্রিল এ চার্জশিটের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি ছিল। শুনানিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন আসামি অহিদুল ইসলাম। শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারা সূত্র জানায়, আদেশের দিন থেকে তিনি কারাবন্দি আছেন। এ অবস্থায় দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দি থাকার বিষয়টি এড়িয়ে তার কার্যালয় (ঢাকা রেজিস্ট্রার অফিস) থেকে ৫ মে নিবন্ধন অধিদপ্তরে একটি পত্র পাঠান ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবরেজিস্ট্রার নোয়াজ মিয়া। সেখানে বলা হয়েছে, ৩০ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ৩ দিন নৈমিত্তিক ছুটিতে ছিলেন অহিদুল ইসলাম। ছুটিকালীন সদর সাবরেজিস্ট্রার হিসাবে আমি (নোয়াজ মিয়া) তার দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু ছুটি অতিবাহিত হওয়ার পরও জেলা রেজিস্ট্রার যোগদান না করে ‘অনুপস্থিত’ আছেন। এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে আপনার (মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন) মতামত প্রয়োজন।’ নোয়াজ মিয়ার এই পত্র পাওয়ার দিনই মহাপরিদর্শক নিবন্ধন উম্মে কুলসুম একটি অফিস আদেশ জারি করেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের ৫ মের পত্রের প্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশ/নিয়মিত কর্মকর্তা যোগদান না করা পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলার জেলা রেজিস্ট্রার মো. জাহিদ হোসেনকে সুবিধামতো সময় নির্ধারণ করে সপ্তাহে ২ দিন নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত জেলা রেজিস্ট্রার ঢাকা এর খণ্ডকালীন দায়িত্বে নিয়োগ করা হলো।’ অহিদুল ইসলামের কারাবন্দি থাকার বিষয়টি চেপে রেখে এমন পত্র দেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নোয়াজ মিয়া বলেন, ‘তার কারাবন্দি থাকার বিষয়টি অফিশিয়ালি আমার জানা নেই। ৩ দিনের ছুটি শেষে তিনি যোগদান না করায় তার অনুপস্থিতির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে নির্দেশনা চেয়ে আমি পত্র পাঠাই। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।’ আর ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার হিসাবে খণ্ডকালীন দায়িত্ব পাওয়া মানিকগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার জাহিদ হোসেন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘অহিদুল ইসলাম আমার ব্যাচমেট, বন্ধু। তবে উনি এখন কোথায় আছেন অফিশিয়ালি সেটা আমার জানা নেই। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করছি মাত্র। সপ্তাহে ২ দিন (সোম ও বৃহস্পতিবার) আমি এই দায়িত্ব পালন করব। কেন আমাকে খণ্ডকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটাও আমার জানা নেই।’ নিবন্ধন অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, অহিদুল ইসলাম যে অপরাধে কারাবন্দি হয়েছেন তাতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। একজন কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতির মামলায় অহিদুল ইসলামের কারাবন্দি হওয়ার খবর আইনমন্ত্রী, সচিব, নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকসহ কর্মকর্তারা সবাই জানেন। তার কারান্তরীণ থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও দাপ্তরিকভাবে তাকে অফিসে ‘অনুপস্থিত’ দেখানো বড় ধরনের প্রতারণা, জালিয়াতি ও অপরাধ। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(ঘ) বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এ বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিধি ১২ অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। বিধি ২৫(১) অনুযায়ী ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে বিধি ৩(ঘ) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো বাধা নেই। জানা গেছে, প্রভাবশালী মহলের ইশারায় শুধু অহিদুল ইসলামকে স্বপদে ফেরাতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। জামিনে বেরিয়েই তার স্বপদে ফেরার আয়োজন করতেই ভয়ংকর এই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। আর এসব কিছুর নেপথ্যে কোটি টাকার বিনিময়ে একজন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আইনজীবী ‘বান্ধবী’ কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ আছে। তার চেম্বারের আইনজীবীরা অতি দ্রুতার সঙ্গে অহিদুলের জামিনের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন। জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম জানান, ‘এ অবস্থায় জামিনে বেরিয়েই তিনি যদি স্বপদে ফেরেন তাহলে সেটা হবে বড় ধরনের অসদাচারণ। মামলা ঠেকাতেও তিনি হাইকোর্টে রিট করে একবার দুদকের কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন। অনেক চেষ্টা করেছেন মামলাটা যাতে না হয়। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করতে সক্ষম হয়েছে। এখন বিভাগ তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’