এমপি আনার হত্যা মাস্টারমাইন্ড শাহীন চাপা পড়ে যাচ্ছে


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে শুরু থেকেই অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম আসছে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টু এবং কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুর নাম আসার পর থেকে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ। আড়ালে চলে যাচ্ছে এমপির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে পরিচিত কিলিং মিশনের মাস্টারমাইন্ড শাহীনের নাম। এছাড়া সামনে আসছে নানা প্রশ্ন। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খুঁজছেন অপরাধজগতের (আন্ডারওয়ার্ল্ড) কানেকশনও। রিমান্ডে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বলেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। অপর আওয়ামী লীগ নেতা বাবু শুক্রবার নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। সূত্র জানায়, ৬ জুন গ্যাস বাবু গ্রেফতারের পর থেকেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নতুন মোড় নিতে থাকে। ধামাচাপা পড়তে থাকে শাহীনের নাম। অথচ শাহীনের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতার উৎস নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আমেরিকা প্রবাসী হয়েও ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলের অপরাধজগত ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তি ছুটে যেতেন ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গী গ্রামে শাহীনের রিসোর্টে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন তারা সেখানে যেতেন? কি এমন ক্ষমতা ছিল শাহীনের? কোন ক্ষমতাবলে শাহীন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণকারী হলেন? আরও প্রশ্ন উঠেছে- এমপি নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেন থানায় জিডি হলো না? জিডি করতে কেন ৬ দিন সময় লাগল? আর জিডির পর পরই বাদী কেন ক্লিনিকে ভর্তি হলেন? সূত্র আরও জানায়, শাহীন হলেন নারী পাচারকারী চক্রের একজন সদস্য। তিনি সব কাজেই নারীদের ব্যবহার করেন। বিভিন্ন সময় তিনি দেশের বাইরে নিয়ে যান নারীদের। তার ঝিনাইদহের রিসোর্টেও ছিল অনেক সুন্দরী তরুণী। ওই তরুণীদের দেখিয়েই তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সেখানে নিয়ে গেছেন। নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের। তার গুলশান এবং ভাটারার বাসাতেও যাতায়াত ছিল অনেক সুন্দরী তরুণী ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের। বাবা হত্যার বিচার চেয়ে এমপির ছোট মেয়ে ডরিন সোচ্চার হলেও বড় মেয়ে ডা. আঞ্জুম ফেরদৌস অরিন সামনে আসছেন না। এমনকি আনারের স্ত্রী ইয়াসমিন ফেরদৌসকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমপি আনারের কলকাতার বন্ধু গোপালের বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য বের হয়ে নিখোঁজ হন। তাহলে আনার যে লাগেজ নিয়ে কলকাতায় যান সেটি নিশ্চয় গোপালের বাসায় থাকার কথা। কিন্তু এখনো কেন ওই লাগেজের খোঁজ মিলছে না? আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ কিলারই গ্রেফতার হয়েছে। তাহলে এখনো কেন এমপি আনারের মোবাইল ফোনসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র উদ্ধার হচ্ছে না? এছাড়া বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরও অনেক প্রশ্ন দেখা দিলেও বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না। এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলায় গ্রেফতার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় গ্রেফতার পাঁচজনের মধ্যে চারজন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতার অপর আসামি মিন্টু ৮ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। শুক্রবার ৭ দিনের রিমান্ড চলাকালীন বাবুকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর বাবু ঘটনার দায় স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমান। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম তার জবানবন্দি রেকর্ড করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে ৬ জুন রাতে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে বাবুকে আটক করে ঢাকার ডিবির একটি দল। পরে ৯ জুন বাবুকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালত তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার বিকালে ধানমন্ডি থেকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় বৃহস্পতিবার তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এদিন তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন তার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শক্রবার ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। ২৩ মে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সেলেস্তি রহমানকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। দুদফায় তাদের ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তারা তিনজনই ঘটনার দায় স্বীকার করে পৃথক দিনে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারাগারে আটক রয়েছেন। ১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে চলছে হত্যা মামলার তদন্ত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এমপি আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু গ্রেফতার হওয়ার পর দলের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছে। কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু গ্রেফতারের পর গোটা অঞ্চলে নতুন করে চরমপন্থি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আনার হত্যার ঘটনাটি ২২ মে প্রকাশ পেলেও নিখোঁজ এমপিকে উদ্ধারের জন্য ১৪ মে থেকেই তৎপর উঠেন ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফসহ পরিবারের সদস্যরা। এমপির কলকাতার বন্ধু গোপাল থানায় ডিজি করেছেন ১৮ মে। ১২ মে আনার যখন রিকশা ভ্যানে বর্ডার ক্রস করছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল কটি ছোট লাগেজ। কিন্তু ওই লাগেজটি এখনো নিরুদ্দেশ। বাবুর দায় স্বীকার : আদালতে কাজী কামাল আহমেদ বাবুর জবানবন্দি রেকর্ড করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক মোহাম্মদ জসীম। এর আগে বাবুকে আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগে অন্যতম আসামি শিমুল ভুইয়া যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাতে বাবুর সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। তার জবানবন্দিতে ভিকটিমকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ ও হত্যা সংশ্লিষ্টতার সাথে আর্থিক লেনদেনে বাবুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে বাবু জানায়, শিমুল ১৫ মে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসে ১৬ মে রাতে তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে। ১৭ মে ফরিদপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিমুলের গাড়িতে সাক্ষাৎ করে ভিকটিমকে অপহরণ ও পরবর্তীতে হত্যাসংক্রান্ত ছবি, টাকা-পয়সা লেনদেন বিষয় নিয়ে গোপনীয় মিটিং করে। এসময় এমপি আনারকে হত্যার-পরবর্তী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে শিমুল বাবুর কাছে দাবীকৃত টাকা চায়। পরে বাবু টাকার আংশিক ২৩ দেয়ার আশ্বাস দেয়।