বরিশালে এমপি হাফিজের বাধায় বন্ধ উচ্ছেদ অভিযান


বরিশালের চরকাউয়া চানপুরা ও টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের সঙ্গে বাকেরগঞ্জের চরাদী চরামদ্দী এবং দুধল ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে সেতু নির্মিত হলেও করা যাচ্ছে না অ্যাপ্রোচ সড়ক। তাই হাঁটার পথে পরিণত হয়েছে যানবাহন চলাচলের সেতু। অ্যাপ্রোচ সড়কের স্থান দখল করে থাকা ১৩টি অবৈধ দোকানের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতির। জেলা প্রশাসনের টিম সরকারি জমিতে থাকা ওইসব দোকান উচ্ছেদে গেলে ফোন করে তা থামিয়ে দেন বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজ মল্লিক। তার এ পদক্ষেপে বিব্রত খোদ জেলা প্রশাসনও। এমপি’র নির্দেশে ফিরে আসার ঘটনায় কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। অ্যাপ্রোচ সড়ক না হওয়ায় কাজে আসছে না ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার সেতু। বন্ধ রয়েছে বরিশাল সদর উপজেলার সঙ্গে বাকেরগঞ্জ উপজেলার সহজ সড়ক যোগাযোগ। বর্তমানে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ ঘুরে বাকেরগঞ্জে যেতে হচ্ছে সদর উপজেলার ৩ ইউনিয়নের বাসিন্দাকে। একই অবস্থা বাকেরগঞ্জের ৩টি ইউনিয়নের। সেই সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সেখানে নির্মিত গুচ্ছগ্রামের ১৭০ পরিবারের ৬শরও বেশি মানুষ। বরিশালের চরকাউয়া চানপুরা ও টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের সঙ্গে বাকেরগঞ্জের চরাদী চরামদ্দী এবং দুধল ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে বছর তিনেক আগে উদ্যোগ নেয় সরকার। এক্ষেত্রে একটি সেতু নির্মিত হলে দুই এলাকার যোগাযোগের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার কমে যাবে বলে রিপোর্ট দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। উদ্যোগের আওতায় বরিশালের চরকাউয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড ও বাকেরগঞ্জের ৩ নং ওয়ার্ডের সীমান্তে থাকা সেকান্দার স্কুল গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন খালের ওপর সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারণ হয়। সেতুটি নির্মিত হলে বরিশাল সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা খুব সহজেই বাকেরগঞ্জ যেতে পারবে বলা হয় প্রকল্প প্রস্তাবে। এক্ষেত্রে বাকেরগঞ্জের ৩টি ইউনিয়নের বাসিন্দারাও খুব কম সময়ে আসতে পারবে বরিশালে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী বছরখানেক আগে কাজ শুরু হয়ে সম্প্রতি শেষ হয় সেতু নির্মাণ। ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় সেতুটি নির্মাণ শেষে অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে এলজিইডি। সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে সড়ক নির্মাণে কাজে বাধা দেয় ১৩ দোকানের মালিক। ফলে বন্ধ হয়ে যায় অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের কাজ। সেই সঙ্গে অকার্যকর হয়ে পড়ে সেতুটি। বর্তমানে পায়ে হেটে সেতুটি পার হওয়া গেলেও চলতে পারছে না কোনো যানবাহন। সেতু সংলগ্ন গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, ‘ব্রিজ হলেও সংযোগ সড়ক না হওয়ায়, এটি এখন কোনো কাজেই আসছে না। আমরা ১৭০টি পরিবার এই গুচ্ছগ্রামে বসবাস করি। আমাদের চলাচলে যে কী দুর্ভোগ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।’ পশ্চিম চরামদ্দি গ্রামের বাসিন্দা জব্বার মাতুব্বর বলেন, ‘আনিছুর রহমান, আ. লতিফ হাওলাদার, নজরুল ইসলাম, মনির খান, আব্দুর রশিদ খান এবং নির্মল চন্দ্র শীলসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী মিলে ওই খান জমি দখল করে রেখেছে। মাত্র এই কজন মানুষের জন্য একদিকে যেমন সেতুটি চালু হচ্ছে না, তেমনি বিপাকে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। এখন আবার শুনছি সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে এমপি সাহেবও নাকি ওই ১৩ জনের পক্ষ নিয়েছেন। অথচ সেতুটি চালু হলে খুব সহজেই আমরা বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদর কিংবা বরিশালে যেতে পারতাম। বর্তমানে আমাদের প্রায় ১০ কিলোমিটার বেশি পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে।’ এ বিষয়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা হলে ২৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনা তদন্তে যান ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা এনামুল হক তালুকদার। তদন্ত শেষে তিনি সেখানে সীমানা পিলার দিয়ে আসেন। এনামুল বলেন, ‘সম্পূর্ণ সরকারি খাস জমির ওপর নির্মিত হয়েছে ব্রিজটি। দক্ষিণ পাশে যে ২শ’ ফুট দৈর্ঘ্যরে অ্যাপ্রোচ সড়ক হওয়ার কথা সেটিও সরকারি জমি। ওই জমি দখল করে ১৩টি দোকান প্রতিষ্ঠান করেছেন স্থানীয় কতিপয় বাসিন্দা। মূলত তারাই বাধা দিচ্ছেন নির্মাণকাজে। বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদন আকারে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) জানিয়েছি।’ উপজেলা ভূমি অফিস জানিয়েছে, ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুসারে ১৩ দখলদারকে সরকারি জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ৪ মার্চ নোটিশ পাঠায় উপজেলা প্রশাসন। নোটিশে ৭ দিনের মধ্যে জমি খালি করে দিতে নির্দেশ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান। এতে কাজ না হলে বিষয়টি জানানো হয় জেলা প্রশাসনকে। ২০ মার্চ ওই ১৩ দখলদারকে দ্বিতীয় দফায় উচ্ছেদ নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন। এবারও সময় দেয়া হয় ৭ দিন। ২য় দফায় দেওয়া ওই নোটিশেও কাজ না হওয়ায় ২৪ এপ্রিল এক নির্দেশে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসন। বরিশালের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সোহেল মারুফ স্বাক্ষরিত নির্দেশ অনুযায়ী গত ১১ জুন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তা শেষ না করে ফিরে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। বাকেরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুর রহমান বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযানে যাওয়ার পর স্থানীয় সংসদ-সদস্য হাফিজ মল্লিকের নির্দেশে তা বন্ধ করে ফিরে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনিই আমাদেরকে অভিযান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তার অনুমতি না নিয়ে সেখানে কোনো অভিযান চালানো যাবে না তিনি জানান। ফলে অবৈধ দখলদারদের স্থাপনাগুলো উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের ওই অংশটি চরামদ্দি মৌজার ১ নং খাস খতিয়ানের ৫৭৪০ নং দাগে অবস্থিত। সেখানে সরকারের প্রায় ১৬ একর জমি রয়েছে। সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কেও ওই খাস জমির ওপর দিয়ে যাবে। কিন্তু অবৈধ দখলদাররা জমিগুলো দখল করে রেখেছে। যে কারণে ব্রিজের সঙ্গে মূল সড়কের সংযোগের কাজও বন্ধ। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এখন তারা যে নির্দেশ দেবেন সে অনুযায়ী কাজ করব।’ বরিশালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে পুনরায় নোটিশ দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করব আমরা।’ দখলদারদের উচ্ছেদে বাধা সম্পর্কে জানতে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তা ধরেননি সংসদ-সদস্য হাফিজ মল্লিক। তার মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি।