পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক কয়েকজন সচিব ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এ ঘটনায় সংস্থাটির ভাবমূর্তি যেমন মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, তেমনি ইমেজ সংকটও হয়েছে। এজন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করাসহ সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের দাবি জানানো হয়।
এক যুগ ধরে সংস্থাটির বিভিন্ন নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বলে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলী স্বীকার করেছে। রোববার বিষয়টি জানাজানি হলে এ নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, ১২ বছরে অনেক পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন তুললে কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না। তা সত্ত্বেও সংস্থাটির যুগ্মসচিব আব্দুল আলীম খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে এত বড় জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে পিএসসিতে কর্মরত যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পিএসসির বাইরের এবং ভেতরে কর্মরত সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করতে হবে। অথবা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে বিষয়টি তদন্ত করা খুবই জরুরি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইঞা বলেন, ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে এবং তা পুনরুদ্ধারের দায়িত্বও পিএসসির। সংস্থাটির চেয়ারম্যান খুবই যোগ্য মানুষ। খুবই ডায়নামিক অফিসার। যা ঘটেছে চোখের অন্তরালে ঘটেছে। এখন তদন্ত করতে হবে। যারা অপরাধী তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে। তদন্তের ফলে বোঝা যাবে পিএসসির দুর্বলতার জায়গাটা কোথায়। সমস্যার উৎস কোথায় তা জেনে সে অনুযায়ী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি। সিস্টেমের মধ্যে সমস্যা থাকলে তা বেরিয়ে আসবে।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক ও লজ্জাকর। পিএসসির মাধ্যমে জাতির মেধাবী সন্তানরা চাকরিতে প্রবেশ করে এবং তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম গৌরব অর্জন করেছে। পিএসসি থেকে যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কিংবা নকল করে পাশ করার সুযোগ দেয় বা কেউ সুযোগ পায়, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা অসম্ভব। পিএসসি জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারবে না। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি যে ইমেজ সংকটে পড়েছে। ফলে সঠিক সুরাহা না হলে জনগণের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে; যা মোটেই কাম্য নয়।
তিনি মনে করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে পিএসসির সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা দরকার। কারণ যে যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে সে তো পিএসসিতেই কর্মরত। সে কী তদন্ত করবে। তিনি আরও বলেন, যারা দায়ী তারাও পিএসসির কর্মকর্তা।
শেখ ইউসুফ হারুন আরও বলেন, আমার সুপারিশ হচ্ছে বর্তমানে অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, সে প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। কিছু সৎ মানুষ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না।
সাবেক সচিব একেএম হাবিবুল্লাহ মজুমদার বলেন, ইমেজ সংকট পুনরুদ্ধারে পিএসসিকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যখন সনাতন পদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হত, তখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, এখন হচ্ছে কেন? এটা সুশাসনের, স্বচ্ছতার অভাব এবং দায়িত্বে অবহেলা। পিএসসি শুধু পরীক্ষা নেবে আর চাকরি দেবে এর মধ্যে সংস্থাটির কাজ সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আগে পিএসসির সচিব ছিলেন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা, এখন সেখানে পিএসসির সচিব হচ্ছেন সরকারের পূর্ণ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাহলে সচিবের দায়িত্ব কী? অর্থাৎ ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়।’ আমার প্রশ্ন-পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায় কী? যে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করুক, দায় কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের। তার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এত বড় দুর্ঘটনা তদন্তে সংস্থাটিতে কর্মরত যুগ্মসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত কমিটি! তিনি কী তদন্ত করবেন। এছাড়া যুগ্মসচিব আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দুজনই একই পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ফলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানো উচিত। তিনি আরও বলেন, পিএসসির সদস্য পর্যায়ের কাউকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হতে পারে। এছাড়া পিএসসি যেহেতু রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ সংস্থা, সেহেতু রাষ্ট্রপতি চাইলে বিচার বিভাগীয় কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করতে পারেন।
সরকারি চাকরির বিধিবিধান গ্রন্থের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রথমত সরকারি কর্ম কমিশনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা জরুরি। কেননা একবার যদি আস্থার সংকটে পড়ে, তাহলে তা ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। ফলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করে যদি বলা হয়, প্রশ্নফাঁসের ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি, তাহলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থেকে যাবে। জনগণ মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, কমপক্ষে পিএসসির সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করতে পারে। যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার পক্ষে এত বড় ঘটনা তদন্ত হলে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতি করে ফৌজদারি মামলা করতে হবে।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো অপরাধ যদি প্রমাণ হয় এবং সেটা যদি পিএসসির এখতিয়ারভুক্ত হয়, তাহলে আইনে যা ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা পিএসসি নেবে। তিনি বলেন, যখনই কোনো পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনো অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পর প্রমাণ কীভাবে হবে? তবে পিএসসি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। ১২ বছর আগের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নিয়েও এই তদন্ত কমিটি কাজ করবে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, পরিপূর্ণ বিষয়টিই আমাদের তদন্তের মধ্যে আছে। তদন্ত প্রতিবেদনে পরিপূর্ণ বিষয়টি আনা হচ্ছে হুবহু কোট-আনকোট করে।
পিএসসির সাবেক গাড়িচালকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় প্রকাশ্যে আসায় পিএসসি বিব্রত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কোনো ঘটনা, সেটা যদি পিএসসিকেন্দ্রিক হয়, তা হলে সেটা আমাদের জন্য কষ্টদায়ক। তিনি আরও বলেন, লটারিতে ছয় সেট থেকে কোনো একটা সেট প্রশ্ন আসে। লটারিতে কোনটা আসবে, সেটা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। আগের পরীক্ষা সম্পর্কে গভীর চিন্তা করতে হবে এবং এটা আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না, সেটাও দেখতে হবে। এখতিয়ারের বাইরে হলে আমরা কী করব?
তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে সব (সেট) প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেটাও আমি বলতে পারব না। আবার সব প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সেটাও আমি বলতে পারব না। তদন্তের আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়। তার দাবি, যদি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে, তাহলে কাউকে ছাড়বে না। এমনকি আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে আমিও শাস্তির বাইরে যাব না। এটা আমি নিশ্চিত করতে পারি।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেন, কাউকে রক্ষা করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কিন্তু কোনো পরীক্ষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ হতে হবে যে এর প্রশ্নফাঁস হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের যে সিন্ডিকেট ধরা পড়েছে, তারা যদি সুনির্দিষ্ট করে জানায় যে, কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে, তাহলে ওই সব পরীক্ষার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এমন জানতে চাইলে প্রমাণিত হলে কমিশনে এটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমি তো এভাবে বলতে পারব না। কমিশনে ঘটনার সার্বিক দিক নিয়েই আলোচনা হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রমাণ হতে হবে। পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি (পিএসসি) রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দিকে লাখো যুবক তাকিয়ে আছে। অনেক সময় বোর্ডের প্রশ্নের মতো দেখতে এমন প্রশ্ন বিক্রি করে একটা চক্র টাকা আয় করে। সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে যে, এখানেও সেটাই হয়েছে কি না। তেমন হলে রাষ্ট্রীয় এজেন্সি সেটা দেখবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সবার ওপরে। আমি না থাকতে পারি, আপনি না থাকতে পারেন, কিন্তু এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান অযথা যেন এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও বিশ্বস্ততা নষ্ট না হয়।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্ম কমিশন সরকারি নিয়োগের একমাত্র স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠানটি নির্মোহভাবে দেশের মেধাবী তরুণদের কর্মসংস্থানের গুরুদায়িত্ব পালন করে গণমানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় হঠাৎ ছন্দপতন।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।