ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পালালেন শেখ হাসিনা-রেহানা
অনলাইন নিউজ ডেক্স
ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় যুক্ত করলেন বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। তারা আবারও প্রমাণ করলেন গুলি চালিয়ে, হামলা করে বা কোনো বাধাতেই আটকে রাখা যায় না সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে। চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন রক্তক্ষয়ী একটি গণঅভ্যুত্থানের সফল সমাপ্তি।
বন্দুকের নল, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও কারফিউ ভেঙে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে মাঠে নামা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পাঁচ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, সাধারণ ছাত্র-জনতা গণভবনে ঢোকার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে গেলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে তাকে ভারতের দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দেশটির গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যখন তিনি দিল্লির উদ্দেশে রওয়ানা হন, তখন বাংলাদেশের ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি গতকাল বিকাল ৪টায় আনুষ্ঠানিকভাবে জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে কাজ পরিচালনা করব। ধৈর্য ধরেন, সময় দিন। আমরা সবাই মিলে সব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবো। সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের আগেই শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়া ও বিদেশ চলে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়। ওই খবরে সারা দেশে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন সাধারণ ছাত্র-জনতা। ঢাকাসহ দেশের জেলা-উপজেলাগুলোতে বের হয় আনন্দ মিছিল। কেউ মাথায় বেঁধে লাল কাপড়, কেউ বা লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা বেঁধে এ উৎসবে শামিল হন। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে জয়ের উচ্ছ্বাস ছিল তাদের চোঁখে-মুখে। পরাধীনতার শিকল ভেঙে নতুন এক স্বাধীনতা অর্জনের তৃপ্তি ছিল চোখে-মুখে। এ যেন নিজ দেশে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার উল্লাস। তারা বলেন, এ প্রজন্মের ’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের স্বাদ দেখা হয়নি। তবে পেয়েছেন নতুন বিজয়ের স্বাদ। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া এসব মানুষের সারিতে ছিলেন শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, দিনমজুর, রিকশাচলক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্লোগানে স্লোগানে তারা বলেন, বাংলাদেশ থেকে এক ‘স্বৈরাচারের’ পতন হয়েছে।
পরিবারের অনুরোধ ও নিজের নিরাপত্তা বিবেচনা করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন বলে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে জানিয়েছেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, তার এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি-আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, তার বয়স সত্তরের ঘরে, তার এত পরিশ্রমের পর একটি ছোট্ট অংশ তার বিরুদ্ধে এমন বিক্ষোভ করল ... তিনি এতে ‘খুবই হতাশ’ হয়েছেন। সজীব ওয়াজেদ জয় আরও জানান, রোববার থেকেই পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করছিলেন শেখ হাসিনা। এবং পরিবারের অনুরোধে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি দেশত্যাগ করেছেন।
এর আগে গতকাল দুপুরে সরকারের পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে চুপসে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে তারা সরে যান। ওই সময়ে রাজধানীতে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন এবং জাতীয় সংসদ ভবনে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়েন। সেখানে তারা সরকার পতনে উৎসব করেন। ভুয়া ভুয়া স্লোগানও দেন। শ্রীলংকার মতোই প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বেডরুমে ছবি তোলেন। নিয়ে যান বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র। এমনকি আসবাবপত্র, পুকুরের মাছ, হাঁস, ক্ষেতের ফসলও নিয়ে যান তারা। জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদ সদস্যদের চেয়ারে বসে ছবিও তোলেন। কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেননি।
বাংলাদেশে কোটা সংস্কারকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তার একটি পরিণতি দেখা গেল শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে। সরকারকে শুরু থেকেই এই আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের অনেকটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা ছিল। নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে তাদের ‘রাজাকার’ ও ‘সন্ত্রাসী’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি এক সপ্তাহের ব্যবধানে শত-শত মৃত্যুর পরও পুরো বিষয়টিকে শুধু বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, এমনকি জঙ্গি হামলা হিসাবে বর্ণনা করে এসেছে সরকার। এমনকি গতকাল সকালেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কুড়িল বিশ্বরোডসহ কয়েকটি এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও সংঘাত-সহিংস ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই পাওয়া গেছে ৪১টি লাশ। এ নিয়ে গত ১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের ৩৪ বছর পর আরেকটি গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হলো, তবে সেটি হলো দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রক্তপাতের মধ্য দিয়ে।
৯ দফা দাবি নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১ জুলাই মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ধীরে ধীরে তারা সারা দেশের বড় সব শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে ছাত্রলীগের পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিও অ্যাকশনে যায়। একপর্যায়ে মাঠে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। সারা দেশে জারি করা হয় কারফিউ। ওই কারফিউ ভেঙেই ছাত্র-জনতা যতই আন্দোলন চালিয়ে যান, ততই তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায় প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় করে, নির্বিচারে গুলিও চালায়। এই অবস্থার মধ্যে শনিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এক বিশাল সমাবেশে সরকার পতনে একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ওই ঘোষণার পরই রাজপথে অবস্থান নেওয়ার পালটা কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। রাজপথে অবস্থান নেওয়াকে কেন্দ্র করে রোববার সারা দেশে ছাত্র-জনতা এবং আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সঙ্গে চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ। ওইদিনই সারা দেশে অন্তত ৯৯ জনের মৃত্যু হয়। আবারও জারি করা হয় কারফিউ। জোরদার করা হয় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা।
ওই অবস্থার মধ্যে সোমবার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই কর্মসূচি পালনে সোমবার ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ এবং উত্তরা দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেন। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টেও জড়ো হন ছাত্র-জনতা। এই কর্মসূচি পণ্ড করতে নির্বিচারে গুলিও চালানো হয়। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে লাখ মানুষের এই মিছিল যখন গণভবন ঘেরাও করতে যাচ্ছিল, অবস্থা টের পেয়ে তখন পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিরাপত্তা বিবেচনায় তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন।
পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে একতরফা নির্বাচন আয়োজন এবং ভোটে কারচুপির অভিযোগও সবচেয়ে বেশি। তার সময়কালেই উচ্চ আদালতের রায় দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার। সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার পরও গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে তাকে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়ী হন। ওই নির্বাচন ছিল একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দল অংশগ্রহণ করলেও আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করায় ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দেন বিরোধীরা।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।