অভিযুক্ত রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধের প্রস্তাব


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগের বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংস্কারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, আইনটাকে আরও যুগোপযোগী ও আধুনিক করতে হবে। এই আইনের আগের বিচার ছিল অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান সংশোধনী প্রস্তাবে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত চাইলে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন। সংশোধনী প্রস্তাবে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এ ছাড়া প্রায় সব রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংশোধনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অংশীজন নিয়ে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া সংগঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনকে সময়োপযোগী ও আধুনিক করার লক্ষ্যে আটটি সংশোধনী প্রস্তাব সভায় উপস্থাপন করা হয়। সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ধারা ৩ (২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে সভায় অতিথিরা গুরুত্বপূর্ণ মত তুলে ধরেন। সভাপতির বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা বিচার প্রক্রিয়ার খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। জুলাই হত্যাকাণ্ডে একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় মেতেছিল। তিনি বলেন, আমাদের বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিতব্য এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই। তিনি বলেন, অতীতে দেখেছি, বিচারের নামে কী ধরনের অবিচার হয়েছে। আমরা দেশের প্রত্যেক মানুষ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। ড. আসিফ আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করা। আইনটির আটটি সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন করার পর তিনি বলেন, এ বিষয়ে মতামত নিতে বিশেষজ্ঞদের কাছে আমরা এটি পাঠাব। এই মতবিনিময় সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ও পরামর্শ উঠে এসেছে। মতবিনিময় সভায় শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, যে কোনো বিচারে প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স টিম থাকে। যেভাবে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়, সেভাবে বিচার করা হবে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এই বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক কোনো বিচারক রাখা উচিত। আমরা সবাই একমত, ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার পেতেই হবে। আমরা জানি, কী অন্যায় হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যে একেবারে নিরপেক্ষ সবকিছু পাওয়া একটু অসম্ভবই বলব। সেই আস্থাটা আনতে একজন অন্তত আন্তর্জাতিক বিচারক বসাতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, খসড়া সংশোধনী দেখে মনে হয়েছে, আসামিদের ইন্টারেস্ট ও রাইটস প্রটেক্টকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। সেখানে আসামিদের পাশাপাশি প্রসিকিউশন যেন বিদেশ থেকে আইনজীবী আনতে পারে, সে রকম বিধান থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে এই আইনকে এমনভাবে করা হোক, যাতে ভুক্তভোগী এবং আসামি উভয়েই ন্যায়বিচার পায়। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়াটি তুলে ধরেন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আশফাকুর রহমান। আইনের ৩(৩) ধারা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিবেচনা করার সুযোগ পাবে। আইনের ৪(২) ধারার সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে– এটি জানার পরও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্তার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান আইনে নেই। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের ভিডিও স্ট্রিমিং বা অডিও ভিজুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচাকার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ, আইন সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব (মতামত) এস. এম. সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম সচিব (বাজেট ও উন্নয়ন) রুহুল আমীন প্রমুখ মতবিনিময় সভায় তাদের মতামত তুলে ধরেন।