নিভে যেতে পারে জুনায়েদের চোখের আলো


স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ২০ বছরের আব্দুল্লাহ আল জুনায়েদ। ১৮ জুলাই বিকেলে শিক্ষার্থীরা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাছের বাজারের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গুলি, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় ডান চোখের ভ্রুতে ছররা গুলি লাগে জুনায়েদের। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা ক্ষত স্থানের কয়েকটি এক্স-রে করে জানিয়েছেন, চোখের কাছে হওয়ায় গুলি অপসারণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। অস্ত্রোপচার করলে সমস্যা হবে রেটিনার। অপারেশন ব্যর্থ হলে নষ্টও হয়ে যেতে পারে চোখ। তবে গুলি চোখের ভেতর চলে গেলে দেখতে পাবেন না জুনায়েদ। গুলিবিদ্ধ স্থানে মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন জুনায়েদ। তখন চোখ খুলতে পারেন না। ব্যথা সহ্য করতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল খান। ড্রপও দেন। যত দিন যাচ্ছে ছররা গুলি আইভ্রু থেকে চোখের দিকে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। মাত্র ২০ বছর বয়সে ডান চোখ হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটছে জুনায়েদের। ঢাকা কলেজের মার্কেটিং বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জুনায়েদ দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। সপরিবারে থাকেন রাজধানী মাতুয়াইলের হাজীবাগে। বাবা আমানতউল্লাহ সড়ক পরিবহন ব্যবসায়ী আর মা রেহানা বেগম গৃহিণী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে ছাত্রীরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজাকার বক্তব্যের প্রতিবাদে মিছিল বের করেছিলেন ২ জুলাই রাত ১২টার পর। তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর, এ এফ রহমান হলসহ বুয়েটের বিভিন্ন হল থেকেও শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হন। জুনায়েদ সেই রাতে স্থানীয় বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিজয় একাত্তর হলে ছিলেন। তাদের সঙ্গে জুনায়েদও আন্দোলনে অংশ নিতে শহীদ মিনারে যান। রাত দেড়টা পর্যন্ত অবস্থান করে রাজু ভাস্কর্যে আসেন। সেখানে রাত ৩টা পর্যন্ত অবস্থানের পর হলে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা। বাড়ি চলে আসেন জুনায়েদও। এরপর ১৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে এসএমএসে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে অবস্থান করার নির্দেশ পান জুনায়েদ। তাকে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র মাহমুদ। মাহমুদের নির্দেশে শনির আখড়ার আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল ৮টার দিকে জড়ো হতে থাকেন। জুনায়েদও ১২-১৩ জন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সেখানে যান। তারা স্লোগান দেন। এমন সময় পুলিশ কাজলা হানিফ ফ্লাইওভারের মুখে অবস্থান নেয়। দুপুর ১২টার পর শিক্ষার্থীদের ওপর তারা ছররা গুলি ছোড়ে। জুনায়েদ ও তার বন্ধুরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধরে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে পুলিশ। বাংলাদেশ বডার গার্ডের সহায়তায় তারা ২০ থেকে ২৫ শিক্ষার্থী দৌড়ে গিয়ে পুলিশের হাত থেকে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। সেখানে অবস্থানরত বিজিবি সদস্যরা তাদের উদ্দেশ করে বলছিলেন, ‘আপনারা আন্দোলন না করে রাস্তা ছেড়ে দিন, আমরা পুলিশ সরিয়ে নিচ্ছি।’ কিন্তু পুলিশ পিছু হটে যাত্রাবাড়ী থানায় অবস্থান নেয়। আব্দুল্লাহ আল জুনায়েদ বলেন, কুতুবখালী যাওয়ার পর আর সামনে এগোতে পারিনি। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী পিছু হটেন। আমরা কয়েক বন্ধু, দনিয়া কলেজ ও এ কে স্কুলের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে নিরাপত্তার জন্য হাতে বাঁশ তুলে নিই। পুলিশের গুলি ভেদ করে সামনে এগোতে থাকি। পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের শেলের ধোঁয়ায় চোখমুখ জ্বলতে থাকে। এক পর্যায়ে পেছনে থাকা ছোট ভাইরা সামনে এগিয়ে আসে সহযোগিতা করতে। ওদের দেওয়া টুথপেস্ট মুখে লাগিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে যাই। এরই মধ্যে বন্ধু ফজলে রাব্বি টিয়ার গ্যাসের শেল আর সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। ওকে একটি ভ্যানে তুলে দিয়ে ফিরে আসতেই স্বচ্ছ, মাসুম, সৌরভ, আশরাফুল এবং আমি গুলিবিদ্ধ হই। আহতরা কুতুবখালী মাদ্রাসা গলিতে আশ্রয় নিই। ফজলে রাব্বিকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দেশ বাংলা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। জুনায়েদ আরও বলেন, সেখান থেকে সামনে গেলে দেখতে পাই পায়ে রাবার বুলেট লেগে বর্ণমালা স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। পুলিশ টেনেহিঁচড়ে ওকে থানায় নিয়ে যায়। এরপর আর ওর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওর লাশও আমরা পাইনি।